চীনা জীবনযাপন
চীনের মানুষ কখনো বুড়ো হয় না অর্থাৎ এরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকে, এদের এমন উপাধি দিলে মনে হয় ভুল হবে না। এখানের একজন সত্তর বছরের বেশি বয়সী পুরুষ কিংবা নারী কোনো ধরনের শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াই প্রতিদিন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। তাই এদের শারীরিক ফিটনেস নিয়ে কিছুটা হলেও আমাদের বিস্মিত হতে হই।
চীনাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস এবং চলাফেরা
চীনাদের সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য দুপুর এবং রাতের খাবারের সময়ের। তারা সকালের নাস্তা অনেক ভোরেই সেরে ফেলে, বলতে গেলে ভোর ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে। বেশিরভাগ অফিসের কর্ম ঘণ্টা শুরু হয় সকাল আটটা থেকে তাই ভোরে নাস্তা করে কর্মক্ষেত্রে রওনা দিতে হয়। এদের দুপুরের খাবারের সময় সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা বাজলেই দুপুরের খাবারের জন্য সবার চোখ মুখে অধীর অপেক্ষার ছাপ দেখা যায় এবং মোটামুটি সাড়ে ১১টার মধ্যে সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে কর্মস্থলে ফিরে আসে। খাওয়ার পরে এক থেকে দেড় ঘণ্টা ঘুমায়। নিজেদের কর্মস্থলেই এই ঘুমের ব্যবস্থা আছে। ঘুমের সময় সবাই লাইট অফ করে, রুমের পর্দা টেনে কর্মস্থলকে ঘুমানোর উপযোগী করে তবেই ঘুমাতে যায়। তখন পুরো অফিসে নীরবতা বজায় রেখে সবাইকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ করে দেয় এবং অফিসের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকে। নির্দিষ্ট সময় ঘুমের পরে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে।
রাতের খাবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে খেয়ে ফেলে এবং সবাই রাতের খাবারের পরে অনেক হাঁটে। তা এক ঘণ্টা থেকে শুরু করে আরও বেশি হতে পারে। শরীর ফিট রাখতে রাতের খাবার সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে খেয়ে এবং খাওয়ার পরে একটু হাঁটাহাঁটি করায় যথেষ্ট বলে মনে করে এরা। এদের খাবারের প্লেটগুলো খুবই ছোট, চপস্টিক (খাবারের জন্য ব্যবহৃত দুটো কাঠি) ব্যবহারে ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে সবাই খুবই পারদর্শী। খাবারে হাতের স্পর্শ এবং চামচ ছাড়া সবরকমের খাবার এই দুই কাঠির সাহায্যে দক্ষতার সঙ্গে খেয়ে ফেলে। প্রত্যেক বার খাবারের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের সুপ খায়। হালকা লবণ মিশিয়ে মাছ বা মাংস বা ডিম বা সবজি পানিতে সিদ্ধ করে সুপ হিসেবে খায়। মন দুশ্চিন্তা-মুক্ত ও প্রশান্তিময় রাখতে এদের অনেক বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। তাই সন্ধ্যায় ডিনারের পরপরই মধ্য বয়সী পুরুষ বা মহিলারা একসঙ্গে সাউন্ড বক্সে গান ছেড়ে মনের উৎফুল্লে নাচে। এই নাচের দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর, সব দলে একজন দলনেতা থাকে, তাকে বাকি সবাই অনুসরণ করে। প্রতিটি কমিউনিটিতে পর্যাপ্ত জায়গা আছে এই নাচের দলের জন্য। কমিউনিটি কর্তৃপক্ষ প্রতিরাতে বড় পর্দায় বিভিন্ন সিনেমা দেখায় এবং সেখানে সবাই সমবেত হয়ে তা উপভোগ করে। রাতের ব্যায়াম শেষে বাসায় ফিরে হালকা গরম পানিতে গোসল করে ঘুমাতে যায়। এরা রাত ১১টার মধ্যে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
প্রতিটি কমিউনিটিতে সুইমিং পুল, এক্সারসাইজের বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থাসহ শিশুদের বিনোদন এবং খেলার জন্য অত্যাধুনিক রাইড আছে। চীনাদের প্রিয় খেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাস্কেটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, গালফ, টেবিল টেনিস ইত্যাদি। কিছু জায়গায় ফুটবল খেলতেও দেখা যায়। কিন্তু ক্রিকেট এরা একেবারেই বোঝে না বা খেলে না।
চীনারা সবকিছুই খায় এবং সবকিছুর ফ্রেশ স্বাদ নিতে পছন্দ করে। এজন্য বিভিন্ন মাংস বা মাছ হালকা সিদ্ধ (কোনো কোনো এলাকায় একেবারে কাঁচা খাওয়ারও রেওয়াজ আছে) করে খায়। শাক-সবজি দুপুরে বাগান থেকে তুলে বিকেলে বাজারে বিক্রি করতে দেখা যায়। মাছ, মাংসের দাম সবজির দামের থেকে কম। এরা সবকিছুই উচ্চ তাপে খুব অল্প সময়ের জন্য রান্না করে। এর স্বাস্থ্য উপকারিতা বেশি বলেই দাবি তাদের। আমরা রান্নায় প্রচুর মসলা ব্যবহার করি, কিন্তু এরা মসলা খুব কম খায়। আমাদের যেখানে একটা আইটেম রান্না করতে ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগে, একই সময়ে ওরা পাঁচটা আইটেম রান্না করে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবারের মেন্যু অর্ডার করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার সামনেই রান্না করে টেবিলে সব মেন্যু চলে আসবে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে একুরিয়ামে জীবিত মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া এগুলো অর্ডার করলে আপনাকে সঙ্গে সঙ্গেই প্রসেস করে রান্না করে দেবে। সব খাবারে বিভিন্ন ধরনের কুকিং ওয়াইন, ভিনেগার এবং কুকিং সস (সয়া সস, ফিস সস, ভেজিটেবল সস, চিলি সস) ব্যবহার করে যেগুলোর অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে। এদের খাবারে ভাতের পরিমাণ খুবই কম থাকে, কম মানে সব মিলিয়ে ৫০ গ্রাম চাল ফুটালে যতটুকু ভাত হয়, কেউ কেউ একেবারেই ভাত খায় না। বিভিন্ন রকম নুডুলসের আধিক্য দেখা যায় এখানে। এদের অনেকে ভাতের পরিবর্তে নুডুলস খায়, কিন্তু তাও পরিমাণে খুব অল্প। তবে, এরা প্রচুর শাক সবজি খায় এবং অনেক স্বাস্থ্য সচেতন তাই শরীরে কোনো রোগ নেই। ভুঁড়ি মোটা চাইনিজ খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয়।
মাছের ব্যাপারে একটু না বললেই নয়। চাইনিজরা জীবিত মাছ খায় (কিছু সামুদ্রিক মাছ ছাড়া)। তাই খোলাবাজার থেকে শুরু করে শপিংমলের একুরিয়ামে সব মাছ রাখা থাকে। সেটা তেলাপিয়া, সরপুঁটি, রুই থেকে শুরু করে চিংড়ি মাছ পর্যন্ত। যখন যে যেমনটা চাচ্ছে সেখান থেকে সে তেমনটা তুলে নিচ্ছে। একুরিয়ামে রাখা মাছ মারা গেলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়ে আলাদা করে অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রি করতে দেখা যায়। মাংসের ব্যাপারেও একটু অন্যরকম। যদি মুরগির কথা বলি তবে দেখা যায়, মুরগির সব পার্ট পার্ট আলাদা বিক্রি হয়। আবার প্রতিটি অংশের দামও আলাদা আলাদা। মজার ব্যাপার হলো এখানে সবকিছুর দামই ৫০০ গ্রামে হিসাব করে, আমাদের মতো কেজিতে না। সুপার-মল, খোলাবাজার সবখানেই দামের একই চিত্র। খাবারে যে ভেজাল মেশানো যায়, এরা কখনো সেই ভাবনা মাথায় আনতে পারে না।
মিষ্টি এরা পছন্দ করে না, এজন্য কোথাও মিষ্টির দোকান আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে, খুবই হালকা মিষ্টি (আমাদের মত চিনির সিরাতে চুবানো না) জাতীয় কিছু খাবার পাওয়া যায়। ভাজা পোড়া খুবই কম খায়, যেহেতু ভাজা পোড়া মুখরোচক তাই তারা পছন্দ করে। কিন্তু, তা সকালের নাস্তার সঙ্গে কিছু কিছু মানুষ খায়। স্টিমে ভাপানো ব্রেড (ডামপ্লিং, মম) খুবই পছন্দের খাবার চাইনিজদের। কোনো রকম লবণ বা মশলা ছাড়া মিষ্টি আলু সিদ্ধ, কলমি শাক সিদ্ধ, বিভিন্ন সবজি সিদ্ধ তাদের খুবই প্রিয়। তবে, বাসায় খাওয়ার চেয়ে বাহিরেই বেশি খায়। তাই এদের জীবন অনেক ঝামেলামুক্ত। নেই বাজার করার চিন্তা বা রান্নার চিন্তা। তবে মাঝেমধ্যে তারা কিচেনেও সময় দেয়।
গ্রিনটি এদের খুবই প্রিয় পানীয়। তাই ছোট থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সবার কাছে গ্রিনটির বড় বড় পট থাকে। সেটাতে বিভিন্ন ধরনের গ্রিন টি, ফ্লাওয়ার টি (বিভিন্ন ফুল শুকানো) ভরে সারাদিন একটু একটু করে গলা ভিজাতে থাকে। স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি এরা খুব কম পান করে। সব ট্যাবে ৪০ ডিগ্রি এবং ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানীয়র ব্যবস্থা থাকে।
এত রকমের ফল যে পৃথিবীতে আছে, এখানে না আসলে হয়তো আমার জানা হতো না। সারাবছরে কিছু কমন ফল ছাড়াও বিভিন্ন সিজনে বিভিন্ন ফল পাওয়া যায়। তবে, সব রকমের ফল এখানে অনেক সস্তা এবং তাজা। সেজন্য দিনমজুর থেকে শুরু করে সবারই ফল খাওয়ার সামর্থ্য আছে। আমার কাছে মনে হয় চীনারা দুপুর বা রাতের খাবারে যতটুকু খাবার খায় তার চেয়ে প্রতিদিনের ফল খাওয়ার পরিমাণ বেশিই হবে। তবে, হ্যাঁ ফল একটু বাসি হলে কেউ তা কেনে না, সবার তাজা জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেশি।
তরুণ প্রজন্মের ফাস্টফুডের প্রতি ঝোঁক আছে। তবে, তা বিশেষ (বার্থডে, ম্যারেজ অ্যানিভারসারি) দিনগুলোতে। এ ছাড়াও, মাঝেমধ্যে দোকানগুলোতে বড় ডিস কাউন্ট অফার করে। এ কারণে ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি, পিজ্জা হাঁটসহ আরও কিছু নামকরা ফাস্টফুডের দোকানে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ব্রান্ডের ওয়াইন, বিয়ার খুব সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায়। এ কারণে এদের প্রচুর ড্রিংক করতে দেখা যায়। কিন্তু, ড্রাঙ্ক অবস্থায় ড্রাইভিং বা লোকাল প্লেসে ঘোরাফেরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি
যেহেতু এরা শারীরিকভাবে খুবই ফিট, তাই ডাক্তারের কাছে কম যেতে হয়। এখানে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার বেশি প্রচলিত। হাসপাতালের বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তাররাও প্রথমে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা দিয়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করেন। সেটা যত কঠিন রোগই হোক না কেন। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করার পরে বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার ভেষজ ওষুধ ডিসপেনসারিতে কিনতে পাওয়া যায়।
ব্যক্তি স্বাধীনতা
এরা সবাই খুবই স্বাধীনচেতা। স্বামী-স্ত্রী সবাই যে যার মতো স্বাধীনতা ভোগ করে এবং কেউ কারো ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পছন্দ করে না। ছেলে-মেয়েদেরও ছোট থেকে সেভাবেই স্বাধীনতা দিয়ে বড় করে। সবাই সেলফ ডিপেন্ডেন্ট অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী কেউ কারো আয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। পারিবারিক জীবনও অনেক সুখের। সবাই সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে পরিবারের সঙ্গে কাছে বা দূরে কোথাও ঘুরতে যায়। প্রতিমাসের আয় থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রেখে দেয় ঘোরার জন্য। জীবনকে যতোভাবে উপভোগ করা যায় তার সব উপায় চীনারা অনুসরণ করে। সামার, উইন্টার বা অন্যান্য ভ্যাকেশনে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস একসঙ্গে ছুটি শুরু এবং শেষ হয়। যাতে ফ্যামিলির সবাই মিলে প্রবাস কিংবা দেশের ভিতরের দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসতে পারে। যাতায়াতের জন্য অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা থাকায় এই সময়ে একটু ভিড় হলেও কখনো কালোবাজারি করে টিকিট বুকিং বা টিকিট না পেয়ে কেউ তাদের গন্তব্যে যেতে পারেনি এমন কিছু শোনা যায়নি কখনো।
মানুষ হিসেবে চীনারা
চীনারা অনেক বেশি শৃঙ্খলিত এবং ছন্দময় জীবনযাপন করতে পছন্দ করে। এদের সবার গায়ের রঙ সাদা। কে কী পোশাক পরলো তা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সবাই খুব সাধারণ পোশাক পরতে পছন্দ করে। এরা অনেক হেল্পফুল এবং অনেক কাজে নিজ থেকে এগিয়ে আসে। বিদেশিদের ব্যাপারে এরা অনেক পজিটিভ মাইন্ডের। ইংরেজি কম পারে ঠিকই, কিন্তু বিদেশি দেখলে নিজেরা আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে, উপকার করতে আসে। এদের কোনো ধর্ম নেই। প্রকাশ্যে ধর্ম পালন এখানে আগে থেকেই নিষিদ্ধ। কে কোন ধর্মের তা এরা নিজেরাই জানে না। তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মানুষ মরতে শোনা যায় না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
এই লেখায় আমার দেখা ফুজিয়ান প্রদেশের ফুজো সিটির মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন নিয়ে আলোকপাত করেছি। চীন বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যাবেষ্টিত অন্যতম বৃহৎ একটি রাষ্ট্র। স্থানকাল ভেদে সবার কালচার, খাদ্যাভ্যাস ভিন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে আমার লেখা নাও মিলতে পারে। আমি চেষ্টা করেছি চীনাদের সংস্কৃতি, চলাফেরা, খাদ্যাভ্যাসসহ কিছু বিষয় তুলে ধরার।
অজয় কান্তি মণ্ডল, গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্টরই ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন।
Comments