স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের দিনেও রক্তাক্ত পাহাড়

বান্দরবানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর চলাকালে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুন পাড়া এলাকায় সাউ প্রু মারমা নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সংকটে আদরের সন্তানকে হারিয়ে গগণবিদারী আর্তনাদ করছেন এক জুম্ম মা। ( ছবিটি ২০১৮ সালের নভেম্বরে বান্দরবান সদর হাসপাতালের মর্গ এলাকা থেকে ছবিটি তোলা)। ছবি: সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া

বান্দরবানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর চলাকালে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুন পাড়া এলাকায় সাউ প্রু মারমা নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে রোয়াংছড়ি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন জানান, সাউ প্রু বান্দরবান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সংস্কার) দলের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সংগঠনটি এ বছরের মার্চে আত্মপ্রকাশ করে।

তিনি সাবেক ইউপি সদস্যও ছিলেন বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

এর আগে, গত শনিবার সন্ধ্যায় বান্দরবানের জামছড়ি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন বাচমং মারমা নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এক সদস্য। ১ সেপ্টেম্বর রাজবিলা ইউনিয়ন যুবলীগের এক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মার্চে গঠন হওয়া সংস্কার দলের বান্দরবান কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির দুই নেতাসহ ছয় জনকে গত ৭ জুলাই বাঘমারা এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৫ জুন বান্দরবানের কুহালং ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ১৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত কেনাইজু পাড়া এলাকায় মগ পার্টির এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন জামছড়ি এলাকার স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা।

২০১৯ সালের ২৫ জুন বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) এক সমর্থককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৭ মে সদর উপজেলার রাজবিলা এলাকায় পিসিজেএসএসের আরও এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর দুই দিন পর একই উপজেলার বাকিছড়া এলাকায় পিসিজেএসএসের আরও এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা এবং পুলাধন তংচংগ্যা নামে একজনকে অপহরণ করা হয়।

১৯ মে সদর উপজেলার রাজবিলা এলাকার এক আওয়ামী লীগ নেতার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং রাজবিলার পার্শ্ববর্তী রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার এক যুবলীগ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

২৫ মে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চ থোয়াই মং এর গুলিবিদ্ধ মরদেহ কুহালং ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

জেএসএস এমএন লারমা (সংস্কার) দলের বান্দরবান কমিটির সেক্রেটারি উবা মং মারমা জানান, চলতি বছরের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামে এক প্রেস কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে বান্দরবানে সংস্কার দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।

বাঘমারায় সংস্কার দলের ছয় সদস্যের হত্যা মামলার ৫ নম্বর আসামী মংপু মারমাকে আহবায়ক করে গত ৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের একটি হোটেলে ইউপিডিএফ (গণতন্ত্র) দলের বান্দরবান জেলা কমিটি গঠন করা হয় বলে কয়েকটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

মং পুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এই কমিটির বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

তিনি বলেন, 'আমি এই কমিটির বিষয়ে কিছুই জানিনা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্য পরিচয় দিয়ে আমাকে কেউ একজন ফোন করে বিভিন্ন সময় মামলার আসামী হয়েছেন এমন নয় জনের একটা তালিকা দিতে বলেন।

‘এখন ইউপিডিএফ (গণতন্ত্র) বান্দরবানের কমিটির তালিকাতে সেসব নামই দেখছি।কিভাবে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না,’ মংপু বলেন।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে সিক্স মার্ডারের ঘটনায় ৫ নং আসামী করা হয়েছিল। এর আগে, ২০১৬ সালে এক আওয়ামী লীগ নেতা হত্যা মামলায়ও আমাকে আসামী করা হয়েছিল।’

মং পু মুরুক্ষং মৌজার হেডম্যান। তিনি বলেন, ‘আমি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু, বিভিন্ন সময় হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হয়েছি। আমি এবং আমার পরিবার প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তায় মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।’

বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. কুদ্দুস ফরাজীর কাছে সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানের আইন-শৃঙ্খলার অবনতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

গত ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা কিছুসংখ্যক সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দিয়ে আসছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তারাই পরবর্তীতে মগ পার্টি নামে এলাকায় জনসংহতি সমিতির সদস্য ও বিভিন্ন পাড়ার নিরীহ বাসিন্দাদের হত্যা ও অপহরণ করছে বলে অভিযোগ করেন জনসংহতি সমিতির কয়েকজন নেতা।

তারা জানান, মগ পার্টির অনেকেই পরবর্তীতে বান্দরবানে মার্চে আত্মপ্রকাশ হওয়া জেএসএস এমএন লারমা (সংস্কার) গ্রুপে যোগ দেয়।

স্থানীয়দের অনেকেই মনে করছেন, মগ পার্টি ও সংস্কার গ্রুপের আবির্ভাবের আগে পর্যটন জেলা বান্দরবানে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় ছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ানের মতে, শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই পাহাড়ে প্রতিনিয়ত সংঘাত বেড়ে চলছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সঙ্কটকে ‘কৃত্রিম সঙ্কট’ বলে উল্লেখ করে গৌতম দেওয়ান বলেন, ‘একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী পাহাড়ে এই সঙ্কট তৈরি করে রেখেছে, যেন এখানে কোনদিনও শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হয়।’

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

12m ago