লালন আছেন সব মানুষের ভালোবাসায়
লালন সাঁইজি নেই আজ ১৩০ বছর। কিন্তু আসলেই কি তিনি নেই? লোকে বলে- লালন আছেন সবখানে। গানে-কবিতায়-আড্ডায়-সিনেমায়-গল্পে-মানুষের ভালোবাসায়- সবখানে লালনের বিচরণ। প্রবল সংকটেও লালনের গান মুখে তুলে নেয় মানুষ। প্রবল ভালোবাসায়ও তার গান কণ্ঠে তুলে নেয়। লালন এমনই এক বিস্ময় জাগানিয়া নাম।
বিবিসির জরিপে বিশ জন সেরা বাঙালির তালিকায়ও আছেন লালন সাঁই।
এ দেশের গ্রাম-শহর-নদী-পাহাড় সবখানের সব বয়সী মানুষের মুখে লালনের গান স্থান করে নিয়েছে। লালনের তিরোধানের এতো বছর পরও তার গানের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে।
লালন মিশে আছেন বাঙালির অন্তরে। অনেক বিদেশির কাছেও লালন এক ভালোবাসার নাম।
লালন সাঁই কী ছিলেন না? তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক, মানবতার প্রতীক, অন্ধকার সমাজের সংস্কারক, সেই সঙ্গে একজন দার্শনিক।
লালন কোনোদিন কাগজে-কলমে গান লিখেননি। গান করতেন মুখে মুখে। তার শিষ্যরা সেই গান মনে রাখতেন। তারপর সেই গান ছড়িয়ে পড়তো দেশের নানা প্রান্তে।
গবেষকদের মতে- দুই হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন লালন সাঁই।
তাকে ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন নামে অভিহিত করা হয়। তাকে বাউল গায়কদের অন্যতম অগ্রদূত বলা হয়ে থাকে। কেউ কেউ তাকে বাউল সম্রাটও বলেন।
মানবতাবাদী সাধকও তিনি। ধর্ম, বর্ণ, ধনী-গরিব, জাতিগত ভেদাভেদ ভুলে মানবতাকে সবচেয়ে উচ্চ আসনে স্থান দিয়ে গেছেন লালন। তাই তিনি ইতিহাসে মানবতাবাদী পুরুষ হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত হয়েছিলেন সেই সময় এবং আজও তাকে মানবতাবাদীদের অগ্রনায়কদের কাতারে রাখা হয়েছে।
লালন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একজন মানুষ। সাম্প্রদায়িকতা থেকে শত মাইল দূরে থেকেছেন সবসময়।
লালনের গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছেন নানাজনকে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকে লালনের গান প্রভাবিত করেছে।
গান্ধীর ২৫ বছর আগে লালন সাঁইকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। লালন এমনই একজন।
লালনকে তার শিষ্যরা সাঁই বলে সম্বোধন করতেন। কখনো গুরু বলে সম্বোধন করতেন। সাঁইজি নামেই বেশি পরিচিতি পান তিনি।
লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেছিলেন। ওই ছেউড়িয়াতেই তিনি শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন, গানও করতেন।
লালনের গানে মানুষ এবং সমাজই ছিল আসল। তার গানে সবার আগে উঠে আসতো মানুষের কথা, সমাজের কথা। এজন্যই তার গান মাটির ও মানুষের কাছাকাছি দ্রুত পৌঁছে গিয়েছিল।
লালন বিশ্বাস করতেন- সব মানুষের মনে বাস করে এক মনের মানুষ। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে।
লালনকে নিয়ে অনেক নাটক, সিনেমা, উপন্যাস ও ছোটগল্প রচিত হয়েছে। বিখ্যাত লেখক শওকত ওসমান লালনকে নিয়ে লিখেছেন ছোট গল্প ‘দুই মুসাফির’।
ভারতের বিখ্যাত বাঙালি লেখক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লালনকে নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস ‘মনের মানুষ’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসের শুরু হয়েছে লালনের ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ লেখাটি দিয়ে।
লালনকে নিয়ে ‘উওরলালনচরিত’ নামে মঞ্চনাটক লিখেছেন সাইমন জাকারিয়া।
১৯৭২ সালে এ দেশে লালনকে নিয়ে সিনেমা পরিচালনা করেন সৈয়দ হাসান ইমাম। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লালনকে নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেন ১৯৮৬ সালে।
তানভীর মোকাম্মেল লালনকে নিয়ে নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র ‘অচিন পাখি’। এ ছাড়া, লালনকে নিয়ে তানভীর মোকাম্মেল একটি সিনেমাও করেন। সিনেমার নাম ‘লালন’।
ভারতীয় পরিচালক গৌতম ঘোষ লালনকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘মনের মানুষ’ নামের একটি সিনেমা।
১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালন সাঁই কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে মৃত্যুবরণ করেন।
লালনের ১৩০তম তিরোধান উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুই দিনব্যাপী লালন জন্মোৎসব ও সাধুমেলা চলছে।
Comments