রোহিঙ্গাদের অপেক্ষায় ভাসান চর
কেউ যখন চরের কথা বলেন, তখন অবচেতন মনেই কল্পনায় ভেসে ওঠে বালুতে ভরা, অনুর্বর কিংবা আবাদযোগ্য কিছু জমির কথা। কিন্তু, হাতিয়ার প্রত্যন্ত দ্বীপ ভাসান চর সম্পূর্ণ আলাদা।
সাদা রংয়ের বহুতল ভবনসহ ক্লাস্টারভিত্তিক আবাসন প্রকল্পের কারণে এটি দেখতে এখন পরিকল্পিত আধুনিক জনপদের মতো। বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, কমন রান্নাঘর এবং খেলার মাঠসহ ভাসান চর রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানাতে বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।
ভাসান চর পরিদর্শনকালে প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘১২০টি ক্লাস্টার গ্রাম নিয়ে তৈরি ভাসান চর এক লাখ মানুষের আবাসনের জন্য প্রস্তুত। আমরা অপেক্ষায় আছি, রোহিঙ্গারা এখানে আসবে এবং থাকবে।’
নৌকায় চট্টগ্রামের মূল ভূখণ্ড থেকে ভাসান চর যেতে দুই ঘণ্টা লাগে। নোয়াখালী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপটিতে পৌঁছালে বিদ্যুৎ ও সোলার প্যানেল, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এবং মোবাইল ফোনের টাওয়ারসহ ভবনগুলো যে কাউকে অবাক করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বাড়িগুলো মাটির চার ফুট উপরে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি। পুরো আবাসন সাইটটির নিরাপত্তায় রয়েছে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা সুরক্ষা বাঁধ।
বাংলাদেশ সরকার তিন বছর সময়ে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই প্রকল্প তৈরি করেছে। এখানে প্রতিটি কক্ষে চার জনের একটি পরিবার থাকবে। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি ভবনের ১৬টি কক্ষে ১৬টি পরিবার থাকবে। জাতিসংঘের আদর্শ হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গার কথা থাকলেও এখানে তারচেয়ে বেশি জায়গা রয়েছে।
প্রকল্পে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠ প্রস্তুত। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসেও খেলার জন্য অতিরিক্ত জায়গা রয়েছে। সেখানে নামাজ, দাফন এবং বাজারের জন্যও জায়গা রয়েছে। সরকার, জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন এনজিওর কর্মকর্তাদের জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে।
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে চলা সামরিক অভিযানের ফলে পালিয়ে আসা সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। এর আগে সামরিক অভিযানের কারণে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া তিন লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে তারা যোগ দেয়। এই রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্যই জনগণের অর্থায়নে এই প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
শরণার্থী শিবিরের তুলনায় এই আবাসন প্রকল্পটি রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক ভালো বিকল্প হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছয় থেকে আট জনের একটি পরিবার সর্বোচ্চ ৪০০ বর্গফুট জায়গার মধ্যে বসবাস করে।
ভাসান চর ২০০৬ সালে জেগে ওঠে। এখানে নির্মিত ভবনের কক্ষগুলোতে স্টিলের বিছানা এবং সিলিং ফ্যান রয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার রয়েছে, যা বিকল্প পানির উৎস হিসেব ব্যবহার করা যাবে।
জনপদের প্রতি ১২০টি প্লটের জন্য আলাদা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। যা এক হাজার মানুষ এবং ২০০ গবাদি পশুর জন্য তৈরি। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলেছেন, সৌর-চালিত স্ট্রিট লাইট ও সার্বক্ষণিক সিসিটিভির মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ভাসান চরের এই আবাসন প্রকল্প এক লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিতে প্রস্তুত এবং এতে করে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ওপর চাপ কমবে।
এই দ্বীপে এখন ৪৩ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, দুটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, দুটি স্কুল ও তিনটি মসজিদ বাসিন্দাদের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে। খাবার ও অন্যান্য পণ্য সংরক্ষণের জন্য চারটি গুদামের পাশাপাশি বাজার রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
এ ছাড়াও, দ্বীপে দুটি বড় হ্রদ রয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উপযোগী লেবু, নারকেল ও কেওড়াসহ বিভিন্ন গাছ প্রচুর পরিমাণে লাগানো হয়েছে এই দ্বীপে।
ভাসান চরের মোট আয়তন প্রায় ১৩ হাজার একর এবং এর মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ৪২৭ একর ব্যবহারযোগ্য। ভাসান চর প্রকল্পের জন্য মোট এক হাজার ৭০২ একর জমি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু, ক্লাস্টার হাউস তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৪৩২ একর জমির ওপর।
সন্দ্বীপ থেকে ভাসান চর সাড়ে চার নটিক্যাল মাইল দূরে এবং নৌকায় যেতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা। এটি হাতিয়া থেকে ১৩ দশমিক দুই নটিক্যাল মাইল, নোয়াখালী থেকে ২১ নটিক্যাল মাইল এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে ২৮ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থিত।
যেকোনো জরুরি অবস্থায় যোগাযোগের জন্য দ্বীপে দুটি হেলিপ্যাড রয়েছে।
ভাসান চরের মুদি দোকানদার মো. রিয়াজ উদ্দিন জানান, প্রায় দুই বছর আগে তিনি এবং আরও শতাধিক ছোট ব্যবসায়ী এই দ্বীপে আসেন। তিনি বলেন, ‘এটা দ্বীপ না। এটা একটা শহর। রোহিঙ্গারা যদি এখানে আসে, তাহলে এটা একটা বড় শহরে পরিণত হবে। আমরা তাদের আসার জন্য অপেক্ষায় আছি। কারণ, তারা এলে আমাদের ব্যবসা আরও বেড়ে যাবে।’
আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের (ভাসান চর প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নাম) পরিচালক মামুন সতর্ক করে জানান, দেড় বছরে মধ্যে স্থানান্তর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে অব্যবহৃত থেকে অবকাঠামোগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
প্রকল্পটি ২০১৭ সালের নভেম্বরে অনুমোদিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নিয়মিতভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেছেন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি আরও জানান, দুটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান উপকূল ও সমুদ্রতীর থেকে দূরে হওয়া কর্মকাণ্ডের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছে।
গত রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানান, ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক এনজিওর পক্ষ থেকে ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরিতকরণের বিরুদ্ধে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও কিছু রোহিঙ্গা ‘চমৎকার সুযোগ থাকায় সেখানে যেতে ইচ্ছুক’।
ভাসান চর আবাসন প্রকল্প পরিদর্শনে যাওয়া রোহিঙ্গা নেতারা বলেছিলেন যে সেখানকার সুযোগ-সুবিধায় তারা সন্তুষ্ট এবং টেকনাফ ও উখিয়া শিবিরে তাদের বর্তমান যে জীবনযাত্রা, তার চেয়ে অনেক ভালো হবে সেখানে।
জাতিসংঘ ও সহায়তা সংস্থাগুলোর যুক্তি, এই দ্বীপটি বিচ্ছিন্ন, বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে এখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা একটি প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন চেয়ে সরকারের কাছে রেফারেন্সের শর্তাদি জমা দিয়েছে এবং এখনো উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়টি হতে হবে স্বেচ্ছায়।
ভাসান চরে একটি বাতিঘর রয়েছে। ৯০ মিটারের একটি টাওয়ারে থাকা এই বাতি ঘরকে বেকন অব হোপ বা আশার আলোকবর্তিকাও বলা হয়। বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের আশঙ্কা এবং বিরোধিতা সত্ত্বেও এই আবাসনটি নিয়ে সরকারের যে প্রত্যাশা ও ভরসা, এটি হয়তো তারই প্রতিচ্ছবি।
Comments