খুবির ৪ শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন কাজের প্রতি নিন্দা জানিয়ে ওই চার শিক্ষককে দেওয়া নোটিশ প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
আজ সোমবার দেওয়া বিবৃতিটিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য ও হাস্যকরভাবে চার জন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে এই অজুহাতে যে, ওই শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন। আসলে তারা যা করেছিলেন তা ছিল ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মৌলিক কিছু চাহিদার যৌক্তিক দাবির সঙ্গে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে একাত্মতা প্রকাশ করা; যা যেকোনো সচেতন শিক্ষকের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধনেই জ্ঞানের চর্চা অগ্রসর হয়ে থাকে, এই বিষয়টি খুবি প্রশাসনের অজানা কি না, তা ভেবে আমরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হচ্ছি।
সেখানে বলা হয়, খুবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উঠে আসা দাবিগুলো ছিলো— আবাসন সংকটের সমাধান, বেতন-ফিস কমানো, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের উৎকর্ষ সাধন, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অবকাঠামো নির্মাণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভূক্তিকরণ এবং অবহিতকরণ। শিক্ষার্থীদের উত্থাপিত এই দাবিগুলোর কোনটাই অন্যায় কোনো দাবি নয়। বরং তা অত্যন্ত ন্যায়সংগত এবং এসব তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। যেকোনো বিবেকবান মানুষ শিক্ষার্থীদের এই দাবির পক্ষে থাকবেন এবং উক্ত শিক্ষকরা সেটাই করেছেন। এজন্য তাদেরকে আমরা সাধুবাদ জানাই। অথচ বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করা গেলো প্রশাসন মৌলিক দাবির আন্দোলনকে কিনা তাদের অসম্মানের বিষয় বলে ভাবছে। যেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নির্ভর করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান ও মুক্তচিন্তার চর্চায় তারা কতটুকু উন্নত সেটার ওপর। অথচ তা নাকি তাদের জন্য লজ্জার! আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আপনাদের এহেন বিতর্কিত ভূমিকা জন্যই বরং আমরা লজ্জিত।
৬০ জন শিক্ষকের সই করা বিবৃতিটিতে আরও বলা হয়, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন হয়েছিল ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। সে ঘটনার পর প্রায় তিন মাস বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকার পরেও; এখন প্রায় নয় মাস পর ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলো। এ ছাড়া, এ আন্দোলনে আরও অনেক শিক্ষক সমর্থন জানালেও, সুনির্দিষ্টভাবে এই চার জনকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পূর্ববর্তী কোনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলেই আমরা আশঙ্কা করছি। ওই ছাত্র আন্দোলনের কাছাকাছি সময়ে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে একজন নারী নিয়োগপ্রার্থীর সঙ্গে যৌননিগ্রহমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছিল এবং আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি ওই ইস্যুতেও এই চার শিক্ষক নৈতিকভাবে অভিযোগকারিণীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কাজেই কারণ দর্শানোর নোটিশে সুনির্দিষ্ট করে উক্ত চার জনকে অভিযুক্ত করানোর প্রক্রিয়াটিকে একটি প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ হিসেবেও ভাবার অবকাশ আছে বলে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
সবশেষে বিবৃতিদাতারা বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসনের এই আচরণ অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ, ন্যাক্কারজক ও হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা মুক্তচিন্তা, জ্ঞানচর্চা ও অন্যায়ের প্রতিবাদে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের কণ্ঠরোধ এবং সুনির্দিষ্টভাবে নিজেদের কোনো দুর্নীতি গোপনের পরিপ্রেক্ষিতে এরকম বিতর্কিত ভূমিকা নিয়েছেন বলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করছি এবং এইরকমের ন্যক্কারজনক ভূমিকার প্রতি তীব্র নিন্দাপ্রকাশপূর্বক, কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রত্যাহার ও উক্ত শিক্ষকদের আর কোনো হেনস্থা না করার আহ্বান জানাই।
বিবৃতিটিতে সই করেছেন— জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেন ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, জাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী ও অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, একই বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন ও সহকারী অধ্যাপক কাজলী শেহরীন ইসলাম, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল লিবারেল স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক দীনা এম সিদ্দিকী, ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান, ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা প্রমুখ।
Comments