সুইডেনের মিড ডে মিল বা স্কুল লাঞ্চ মডেল
প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়া বন্ধ, লেখাপড়ায় মনোযোগ বাড়ানো ও শিশু শিক্ষার্থীদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে মিড ডে মিল একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পৃথিবীর অনেক দেশে কয়েক দশক আগে থেকেই এ ব্যবস্থা চালু আছে। সুইডেনের স্কুলগুলোতে প্রায় শত বছর ধরে এটি চলছে। এখানে এখন সরকার প্রতিবছর বিনামূল্যে ২ কোটি ৬০ লাখ মিল বা খাবারের প্যাকেট সংগ্রহ করে থাকে।
এ নিয়ে লিখতে চাই কারণ, বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে মিড ডে মিল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। তবে প্রশ্ন উঠেছে মিড ডে মিল সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরকে ঘিরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে হয়েছে ব্যাপক সমালোচনাও।
সাধারণ মানুষের ভাবনা খুব একটা অমূলক নয়। তার পেছনে বেশ কিছু যুক্তি রয়েছে- প্রথমত, যেসব দেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে সেসব দেশের খাদ্য সংস্কৃতি ও শিশুদের খাদ্যাভ্যাস এক নাও হতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ যেখানে ভাত, মাছ, সবজির মতো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত সেখানে ভিন দেশের খাদ্যে আমাদের দেশের শিশুরা কতটুকু স্বচ্ছন্দ্যবোধ করবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। তবে ঠিক কী বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে তা স্পষ্ট হলে ভালো হতো। কী খাবার দেয়া হবে তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কী করে শিশুদের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার ব্যবস্থা চালু করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করা।
আর প্রশিক্ষণ যদি নিতেই হয় সেক্ষেত্রে কী করে পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়মতান্ত্রিক ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করা যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া। তবে কাজটি করতে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। প্রযুক্তির এই যুগে দেশে বসেই বিভিন্ন দেশের এই কার্যক্রমগুলো সম্পর্কে খুব সহজেই জানা এবং সেই অনুযায়ী কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব।
উদাহরণ হিসেবে আজ সুইডেনের মিড ডে মিল বা স্কুল লাঞ্চ মডেলের কথা লিখতে চাই। এখানে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে ঊনিশ শতকের শুরু বা প্রায় শত বছর আগে। সত্তরের দশকে এখানকার বেশিরভাগ স্কুলের আওতায় আসে। এখানে ৭ থেকে ১৬ বছর এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সি সব শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন স্কুলে বিনামূল্যে স্কুল লাঞ্চ বা দুপুরের খাবার দেয়া হয়।
২০১১ সালে বিষয়টি সুইডিশ স্কুল আইনে অন্তর্ভূক্ত করে বলা হয়, স্কুল লাঞ্চ অবশ্যই পুষ্টিকর হতে হবে এবং তা যেন শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনকার পুষ্টি ও শক্তি চাহিদার এক তৃতীয়াংশ পূরণ করে।
সুইডেনের স্কুলগুলোতে সরকার প্রতিবছর বিনামূল্যে ২ কোটি ৬০ লাখ মিল বা খাবারের প্যাকেট সংগ্রহ করে থাকে। খাদ্য তালিকায় রয়েছে- সালাদ, রুটি, ঘি, দুধ ও পানি। খাবারের ধরনে ভিন্নতাও নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। এ জন্য প্রতিবছর একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় হয় ৬ হাজার ৪শ সুইডিশ ক্রোনা যা টাকার অংকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। মূলত খাদ্য, পরিবহন ও এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের পারিশ্রমিকের জন্য এই টাকা খরচ হয়। সেই হিসেবে প্রতি ইউনিট খাদ্য উপকরণ বাবদ খরচ হয় ১০ সুইডিশ ক্রোনা বা প্রায় ১শ টাকা।
এই টাকার যোগান আসে অঞ্চলভিত্তিক ট্যাক্স থেকে। এখানকার সিটি করপোরেশনগুলো নিজ নিজ এলাকার স্কুলে গুণগত মানের খাদ্য উপাদান সরবরাহ, খাবার রান্নার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে আসছে।
সিটি করপোরেশনের তদারকিতে এলাকাভেদে বিভিন্ন খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকেও এই কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। অনেক স্কুলে তাদের নিজস্ব রান্নাঘরেই খাবার তৈরি হয়। আবার বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের নিজস্ব বড় পরিসরের রান্নাঘর এবং সরবরাহ ব্যবস্থা থাকায় তারা নিজেরাই রান্না ও খাবার বিতরণের কাজটি করে।
প্রতিটি স্কুলে গরম অথবা ঠান্ডা অবস্থায় খাবার সরবরাহ করা হয়। খাওয়ার আগে শিক্ষার্থীরা যাতে খাবার প্রয়োজনমতো গরম করে খেতে পারে স্কুলগুলোতে সেই ব্যবস্থাও রয়েছে। মিউনিসিপ্যালিটি ছাড়াও বিভিন্ন ফুড অপারেটর কোম্পানিও পুরো প্রক্রিয়াটির দায়িত্ব পালন করতে পারে। তবে সে জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে সুইডিশ ফুড এজেন্সির অনুমোদন থাকতে হয়।
অনুমোদনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনা করা হয় সেগুলো হলো- খাদ্যপণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখতে পারা, সময়মতো খবার সরবরাহ করা, খাবার তৈরির পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের এই খাবার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করতে পারা।
অনুমোদনের যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয় তা হলো- স্কুল লাঞ্চ শিক্ষার একটি অংশ এবং দুপুরের খাবার গ্রহণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এখানে লক্ষ্যনীয়, সুইডেনের যেসব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এ কার্যক্রমগুলো সফলভাবে পরিচালনা করে আসছে সেসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মতো প্রায় একই ধরনের প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক অবকাঠামো আমাদের দেশেও আছে। যেমন সুইডিশ মিউনিসিপ্যালিটির মতো দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, খাদ্য অধিদপ্তর, পুষ্টিবিদসহ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এর সাথে যুক্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া, সরকার চাইলে দেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, দাতব্য সংস্থাও মহৎ এই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক: মাফি ইসলাম, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গ, সুইডেন
Comments