ধর্ষণ আইনে ‘ফাঁসির আদেশ’ তবে মামলার ট্রায়ালে ভিকটিম কেন?
এক ঠিকা-ঝি তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটা বাসায় কাজ করেন। মেয়েটা কথা বলতে পারে না। যে বাসাগুলোতে কাজ করেন, তারই মধ্যে একটি বাসার মানুষ মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা প্রদান করেন এমন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন কারণ মেয়েটির ‘যৌনাঙ্গ’ তে ভয়াবহ ঘা হয়ে গেছে। কেউ একজন ধর্ষণ করবার জন্য তার যৌনাঙ্গে কিছু দিয়ে ফেঁড়ে দিয়েছে। মেয়েটার মা একটা মেসবাড়িতে পাঁচ বছরের কন্যা শিশুকে বারান্দায় বসিয়ে ২৭ জন পুরুষ থাকেন এমন জায়গাতেও ঘর মোছার কাজ করেন। মেয়েটা তার মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না ‘তার ওই বিশেষ জায়গায় ঘা থেকে ক্ষত থেকে পচন ধরল কীভাবে?’ বাক প্রতিবন্ধী মেয়েটা শুধু কাঁদে।
এই ঘটনা আজ থেকে বছর ১০ আগেকার—নোয়াখালী এলাকাতেই। চিকিৎসা নিয়ে কন্যাশিশুকে সুস্থ করে মা মেয়ে সমেত উধাও হয়ে গেছেন। আমাদের হাতে কোন ভিডিও ছিল না। কয়দিন ধরে, আন্দোলন, ধর্ষণ, ধর্ষণের ফাঁসি চাই স্লোগানের মুহুর্মুহু আওয়াজে আমি ভাবছিলাম ২০০৩ সাল থেকে ১৭ বছর প্রায় যে অজস্র নারীর নিপীড়ন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে গেলাম- যেসব বয়ান মনোরঞ্জনমূলক যথেষ্ট রগরগে নয়— সেসব নিয়ে গবেষক আমি কী করব?
ধর্ষণ আইন নিয়ে যে আলোচনা আন্দোলনে সে প্রেক্ষিতে এই ধরে নেওয়ার কোনো অবকাশ নাই যে বাংলাদেশের মানবাধিকার এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন সংগঠনগুলো একত্রিতভাবে সমস্বরে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন থেকে শুরু করে ধর্ষণ আইনের দ্বৈততা, বিচার সংস্কৃতি ও তার বাস্তবতার ফাঁকফোকরগুলো নিয়ে কাজ করছেন না। ১০টি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কেবলমাত্র ধর্ষণ আইন পুনর্গঠন প্রসঙ্গে কোয়ালিশানে কাজ করছেন। দুই আঙ্গুলে নারীর সতীত্ব পরীক্ষার মতো যে মেডিকোলিগেল বাস্তবতা বর্তমান রয়েছে তার ভিত্তি যে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা সেটি কিন্তু স্বয়ং কোনভাবেই আইনি ব্যবস্থা খারিজ করে নাই। সে নিয়েও দীর্ঘসূত্র আন্দোলন জারি আছে।
প্রশ্ন হলো, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতায় যে সার্ভাইভার সমাজে বসবাস করেন তারা সমাজে কোথায় থাকেন? নিরাপদে তাদের বসবাস নিশ্চিত করবার লড়াই কেমন হয়— সেই প্রশ্ন কী আমাদের সদা মনোরঞ্জনকামী মগজে আসে?
২
আছিয়া (ছদ্মনাম) নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নারী। তার সঙ্গে এক প্রবাসীর বিয়ে হয়। বিয়ের ছয় মাস পর গর্ভবতী আছিয়াকে রেখে স্বামী প্রবাসে চলে যান। উচ্চ মধ্যবিত্ত ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শ্বশুড়বাড়িতে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ‘সুন্দরী’ আছিয়ার গর্ভপাত হলো। এরপর বাড়ির কর্তা, আছিয়ার দেবর আড়তদার, স্বামীর অবর্তমানে তাকে বিভিন্ন মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করলেন। বিষয়গুলো স্বামীকে ফোন মারফত প্রবাসে জানালে স্বামী আছিয়াকেই মানিয়ে চলবার নির্দেশ দেন। শ্বশুড়বাড়িতে শাশুড়ি, ননদ কেউ আছিয়ার পক্ষ নেননি এবং দরিদ্র বাবার বাড়িতে তার ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এক সন্ধ্যায় হাতে বাল্ব নিয়ে দেবর হুমকি দেন আছিয়া তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন না করলে, দেবর তার শরীরে এসিড ছুঁড়ে মারবেন। আছিয়ার পেট পিঠ কোমর স্তন এসিডে ঝলসে যায়। ঘটনা ধামাচাপা দিতে আছিয়ার শাড়ীতে মোমবাতির আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় যাতে পরীক্ষায় ফ্লেম বার্ন আসে এবং আছিয়াকে টানা ৭ দিন লেপ দিয়ে মুড়িয়ে ঘরের ভেতর আটকে রাখা হয়।
৭ দিন পর আশপাশের মানুষ, পুলিশের সহায়তায় মানবাধিকার কর্মীদের সাহায্য আছিয়াকে উদ্ধার করা হয় এবং তিনি বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় পক্ষের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন মানবাধিকার, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনুদানে সাত বার শরীরে অস্ত্রোপচার করে খানিক সুস্থ হয়ে উঠেন। এই মামলা পরবর্তীতে খারিজ হয়ে যায়। কারণ যে নারী অধিকার কর্মী আছিয়াকে আশপাশের মানুষ ও পুলিশের সাহায্য নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিলেন তার ভিকটিমের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় নারী অধিকার কর্মীর কিশোর বয়সী ছেলেকে ২১ দিনের জন্য অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মাঝে আছিয়ার প্রবাসী স্বামী বিদেশ থেকে এই মর্মে আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেন তার স্ত্রী আছিয়া ব্যভিচারী। আছিয়া তার নিজের দেবরের সঙ্গে ‘অবৈধ’ শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করতে অপারগ হওয়ায় নিজের গায়ে নিজে এসিড ঢেলে দিয়েছেন। স্বামীর সাক্ষ্য মহামান্য বিচারপতি গ্রহণ করেন; মামলা খারিজ হয়ে যায়। যদিও প্রতি বছর আছিয়ার শরীরের এসিডের ঘা নতুন করে পচন ধরে, সকল ঘা নতুন করে তীব্র যন্ত্রণার জন্ম দেয়।
সামাজিক যে আদালত আমাদের আছে তাতে আছিয়ার মতো নারীরা শরীরে যন্ত্রণার ঘা/ চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও, নিজ শরীরে সাক্ষ্য বহন করা সত্ত্বেও ‘দুশ্চরিত্রা’ লেবেল পান এবং মামলা খারিজ হয়ে যায়। নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ আদতে আদালত পাড়ায় গিয়ে কী দাঁড়ায়— এই প্রশ্ন উত্থাপনই জরুরি নয়? নাকি খুব মনোরঞ্জনমূলক না হলে আমরা এসবে সমাজের মানুষেরা কথা বলতে ভালো বোধ করি না!
৩
নিজের কাজের জন্য, কিছু নারীর বয়ান লিপিবদ্ধ করছিলাম। সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন এমন নয় জন নারীর বয়ান বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। এদের কেউই তাদের নিজেদের ধর্ষককে চিহ্নিত করতে পারেন না। এটা ভাববার কোনো কারণ নেই যে নিপীড়ন ঘর থেকে/ চেনা মানুষ কিংবা বাসার মানুষ থেকে শুরু হয়নি। বরং এমনভাবে নারী জীবনের নিপীড়ন বাস্তবতা শুরু হয়, এমন বয়স থেকে যে নিপীড়ন বাস্তবতা বহুস্তরীয় বহুমাত্রিক হয়ে যায়।কন্যা শিশু এমন বয়সে পিতা/ভাই কর্তৃক/আত্মীয়/আশ্রয়দাতার হাতে ধর্ষণের নিপীড়িত একজন হয়ে বাড়ির বাইরে-ঘরের বাইরে দৌড়াতে শুরু করেছেন যখন থেকে তার জীবনে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যেসব ঘটনার বহুকিছু তার মনোশারীরিক নির্যাতনের কারণেই স্মরণে নাই। নারী বলেন ‘ব্রেইনে ধরে না’। ৯ জন নারীর প্রত্যেকের শরীরেই কোন না কোন ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। যেমন মাথার খুলিতে গভীর আঘাত, দাঁত পড়ে গেছে, গালে আঘাতের চিহ্ন, হাতে আঘাত, বাম পা খুঁড়িয়ে হাঁটে, দুই হাতের দুটো আঙুল কাটা ইত্যাদি।
ধরুন, একজন আশাকে তার বাবা মাত্র আট বছর বয়সে ধর্ষণ করেছে। চাতালের ছাউনি থেকে পালিয়ে আশা দৌড়াতে শুরু করেছে। বহুদূর এসে জামিলা নামের কোন এক আপার কাছে আশ্রয় পেয়েছে। ভাতের হোটেলে আশা মশলা পিষেন সঙ্গে তাকে খদ্দেরও সামলাতে হয়। তারপর ১৫ বছর বয়সে বেনাপোল সীমান্ত পার হতে গিয়ে বাংলাদেশের পুলিশ তাকে উদ্ধার করে জেলে নিরাপত্তায় রেখেছে। এরপর জেল থেকে পুনর্বাসনে আছেন আজকে ১৩ বছর।
ফাঁসি কার হবে?
৪
ধর্ষণ, একটি ফৌজদারি অপরাধ। এর সঙ্গে নারীর উপরে পুরুষালী ক্ষমতা চর্চার গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে আমরা বীরাঙ্গনা সনদে কোনো কোটা পাই না। বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যেতে হয়। বীরাঙ্গনাদের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর প্রতীক এরকম বীরত্বের সম্মাননার উচ্চতম শিখর হয় না। বীরাঙ্গনা বীর শ্রেষ্ঠ হয় না আমাদের সমাজে। কারণ দেহে বীরত্ব ধারণ করলে সেই দেহ আদতে সমাজ ও পরিবারের ‘পবিত্রতা’ ধারণের সক্ষমতাই রাখে নাই। বীরাঙ্গনার সন্তান সম্মানের হয় না এই সমাজে!
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ইতিহাসে যে বীরাঙ্গনা নারীকে জাতি অসম্মানিত করেছে সে জাতির ভিক্টোরিয়ান ধর্ষণ আইনে ‘ভিকটিম ট্রায়ালে’ থাকে। ভিকটিমকে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন— তার চরিত্র দিয়ে, তার সাক্ষ্য দিয়ে, তার ধর্ষণের ভয়াবহতা দিয়ে, তার সতীত্ব দিয়ে আর আপামর জনসাধারণের কাছে কতটা ‘সেনসেশনাল’ লাগছে ধর্ষণের কাহিনী— বস্তুনিষ্ঠ সত্যতা তার ভিত্তিতে। মানেটা এমন যে, আমাদের বিচারব্যবস্থা স্বয়ং আমাদের সামাজিক বিচারের ধর্ষণ বিষয়ক মিথকে ধারণ করেন; আদতে আইন সমাজের ভেতরে থেকে সামাজিকভাবে বিশেষভাবে পুরুষালী মনস্তত্ত্ব থেকে নির্দিষ্ট করে দেয় যে কার কার কখন কখন কীভাবে ধর্ষণ হতে পারে কিংবা পারে না।
ফৌজদারি আইনি লড়াইয়ে রাষ্ট্র ভিকটিমের পক্ষে থাকে। আর রাষ্ট্রের বিপক্ষে বিবাদীকে, যিনি অভিযুক্ত তাকে/ তাদেরকে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি খুনটা/ অপরাধ সংঘটিত করেন নাই। যে সমাজে ‘দুশ্চরিত্রতা’ হলে ধর্ষণের মামলা খারিজ হয়ে যায় সেখানে ফাঁসির আদেশ আদতে কার জন্য কাদের সন্তুষ্টি ও বেঁচে যাওয়ার তরিকা হবে—পুনরায় জোরালোভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। কারণ ধর্ষণ মামলায় যখন ভিকটিম ট্রায়ালে থাকে, এটা কি ভাবতে পারি না স্বয়ং ‘রাষ্ট্র’ ট্রায়ালে থাকছে? তাহলে বিচার ব্যবস্থায় ধর্ষণ মামলায় ট্রায়ালহীন আদতে (রাষ্ট্রের পক্ষের জন) কে কে কারা কারা?
পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতা? তবে কি ধর্ষণ মামলাগুলো ভিকটিম বনাম রাষ্ট্রপক্ষ?
ফাতেমা শুভ্রা: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments