ইতালিতে বাংলাদেশি শ্রমিক আমদানি, প্রতারণার হাতছানি
ইতালিতে প্রতিবছর সিজন্যাল চাকরি করার জন্য কিছু শ্রমিক আমদানি করা হয়। তারা সাধারণত কৃষি ও পর্যটনক্ষেত্রে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। ছয় থেকে নয় মাসের মৌসুমী কাজের জন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের মেয়াদ শেষ হলে ফিরে যেতে হয় নিজ দেশে। অনেক বছর থেকে এভাবেই চলে আসছে। প্রথমদিকে এই তালিকায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের কোটা থাকলেও ২০১২ সাল থেকে সে কোটা বাতিল করা হয়। দীর্ঘ আট বছর বাংলাদেশকে রাখা হয় নিষিদ্ধের তালিকায়।
২০২১ সালের সিজন্যাল শ্রমিক আমদানির জন্য ইতালিয় সরকার গত ১২ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করে এবং এ বছর বাংলাদেশকে নিষিদ্ধের তালিকা থেকে তুলে নেয়। অর্থাৎ ২০২১ সালের সিজন্যাল চাকরির জন্য বাংলাদেশ থেকেও শ্রমিক আসতে পারবে।
গত ৮ বছর থেকে বাংলাদেশি সিজন্যাল শ্রমিক ইতালিতে নিষিদ্ধ থাকলেও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা থেকে শ্রমিক আমদানি অব্যাহত ছিল।
২০২১ সালে এশিয়ানর আটটি দেশসহ মোট ৩০টি দেশ থেকে ৩০ হাজার ৮৫০ জন শ্রমিক আমদানি করা হবে। এর মধ্যে ১৮ হাজার শ্রমিক ইতালিতে সর্বোচ্চ নয় মাস থাকতে ও কাজ করতে পারবে। ১২ হাজার ৮৫০ জন শ্রমিক যদি চাকরির জন্য স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবে যারা নিয়মিত থাকতে ও কাজ করতে পারবে। এই শ্রমিদের অবশ্যই কোনো না কোনো কাজে দক্ষ হতে হবে। এর মধ্যে আলাদা করে ৬ হাজার জনের কোটা বেঁধে দেওয়া হয়েছে যারা শুধুমাত্র মালামাল বহনকারী গাড়ির চালক, আবাসিক হোটেলের কর্মচারী ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট চাকরির জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
দুই ভাগে বিভক্ত করে অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু হয়েছে ২২ অক্টোবর থেকে, চলবে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত।
কারা আবেদন করতে পারবেন?
কোনো শ্রমিক সরাসরি আবেদন করতে পারবে না। শ্রমিকের পক্ষে নিয়োগদাতা মালিক অনলাইনে নির্দিষ্ট ফর্ম পুরণ করে আবেদন করবেন। এ ক্ষেত্রে আবেদনকারীর প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ঘাটতি দেখাতে হবে এবং তার বিগত দিনের ট্যাক্স প্রদান নিয়মিত থাকতে হবে।
নিয়োগপ্রাপ্ত হতে কী যোগ্যতা লাগবে?
বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। উল্লেখিত ৩০ দেশের নাগরিক হতে হবে এবং বৈধ পাসপোর্ট থাকতে হবে। যারা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন তাদের কর্মদক্ষতার প্রমাণাদি থাকতে হবে।
কত খরচ হবে?
আবেদন করতে শ্রমিকের খরচ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবেদনকারী বা নিয়োগদাতার খরচ হবে ১৬ ইউরো। অর্থাৎ আবেদনের সঙ্গে ১৬ ইউরো মূল্যের একটি ডাকটিকেট সংযোগ করতে হবে।
কত টাকা আয় করা যাবে?
যারা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে আসবেন তারা নিয়োগের স্তর বুঝে পারিশ্রমিক পাবেন, যা মাসিক ১,৫০০ থেকে ২,৫০০ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। যারা অদক্ষ মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে আসবেন তারা মাসে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করতে পারবে। যদি নিয়োগদাতার সঙ্গে থাকা-খাওয়ার চুক্তি থাকে তবে আয়ের বড় অংশ সঞ্চয় করা সম্ভব হবে, অন্যথায় এতেই বড় একটা অংশ খরচ হয়ে যাবে।
কতদিন ইতালিতে থাকা ও কাজ করা যাবে?
যারা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে আসবেন তাদের চাকরির মেয়াদ যতোদিন থাকবে ততদিন তাদের ইতালিয় ডকুমেন্ট নবায়ন করা হবে। যারা অদক্ষ বা সিজন্যাল ভিসায় আসবেন তারা সর্বোচ্চ নয় মাসের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারবেন। অর্থাৎ, নয় মাস পর তাদের অবশ্যই নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। না গেলে তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য করা হবে।
আমাদের কমিউনিটিতে কী হচ্ছে?
দীর্ঘ আট বছর পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের ইতালিতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এই সংবাদ ছড়িয়ে এক শ্রেণির দানব মানুষ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা দেশের সাধারণ মানুষকে ভুল দিয়ে বিভ্রান্ত করছে। মানুষের কাছ থেকে লাখ-লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ পেতেছে। তারা মানুষকে বোঝাচ্ছে আবেদন করলেই ইতালিতে আসা যাবে। এসব বলে জনপ্রতি ৮ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হাঁকাচ্ছে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো- আবেদন করলেই ইতালিতে আসা যাবে না।
মনে রাখতে হবে, মোট শ্রমিক আমদানি করা হবে ৩০ হাজার ৮৫০ জন। এই সংখ্যা ৩০টি দেশের মধ্যে ভাগ হবে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর শ্রমিকরা ও বিগত বছরগুলোতে যেসব শ্রমিক ইতালিতে এসেছেন এবং নিয়োগের মেয়াদ শেষ হলে নিজ দেশে ফিরে গেছেন তারা অগ্রাধিকার পাবেন।
আমরা ইতালি থেকে জানতে পারছি দালাল শ্রেণির মানুষদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে দেশের অনেক মানুষ ভিটে-মাটি বিক্রি করে তাদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন, যা অত্যন্ত আতঙ্কের বিষয়। এই টাকা তাদের পক্ষে ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
আবার অনেকে অগ্রিম ২/৩ লাখ টাকা করে নিচ্ছে এই শর্তে- যদি আবেদন গ্রহণযোগ্য হয় তবে বাকি টাকা দিয়ে ভিসার অনুমোদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। আবেদন গ্রহণযোগ্য না হলে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা খরচ বাবদ কেটে রেখে বাকি টাকা ফেরত দেওয়া হবে। অর্থাৎ, তারা একেকজন ১০ জন, ২০ জন বা তারও বেশি মানুষের কাছ থেকে ২/৩ লাখ টাকা করে নিচ্ছে। এই বিপুল টাকা এক-দেড় বছর নিজের ব্যবসায় খাঁটিয়ে হয়তো কিছু কিছু করে ফেরত দেবে।
আতঙ্কের বিষয়!
যারা দালাল শ্রেণির মানুষদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে ভিটে-মাটি বিক্রি করছেন, বন্দক রাখছেন তাদের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যারা বিপুল অংকের টাকা খরচ করে সিজন্যাল ভিসায় আসতে পারবেন তারা নয় মাসে খরচের টাকা সঞ্চয় করতে পারবেন না। অবৈধ হয়ে পালিয়ে থাকতে হবে। মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে। এর ফলে আবারও নতুন করে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর নিষিদ্ধের খড়গ নেমে আসার আশঙ্কা তৈরি হবে।
২০১২ সাল থেকে দীর্ঘ আট বছর ইতালিতে বাংলাদেশি শ্রমিক নিষিদ্ধ থাকার অন্যতম কারণ হলো ২০১২ সালের আগে যারা এসেছেন তাদের কেউ ভিসার মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে যাননি। টাকার বিনিময়ে আবেদন করা অধিকাংশ নিয়োগদাতা ইতালিতে আসার পর শ্রমিকদের চাকরি দেয়নি। বিমানবন্দর পার করেই তারা দায়িত্ব শেষ করেছে। এসব নিয়ে কমিউনিটিতে বহু মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে। থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। দেশেও শ্রমিকদের পরিবারগুলো নানাভাবে অত্যাচারের শিকার হয়েছে।
Comments