নোয়াখালীতে প্রতি চার দিনে একটি ধর্ষণ

নোয়াখালীতে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত ৫০ দিনে দেশব্যাপী সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় সৃষ্টিকারী নারী নির্যাতনসহ ১৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে নোয়াখালীতে। গড়ে প্রায় প্রতি চার দিনে একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
ধর্ষণ থেকে রেহাই পায়নি শিশু ও প্রতিবন্ধীরাও। এসব ধর্ষণের মধ্যে রয়েছে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের ভিডিও ধারণ।
গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া এসব ধর্ষণের ঘটনায় আশার আলো এটাই যে এসব ধর্ষণের ঘটনায় প্রায় সব অভিযুক্তকেই গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনেছে পুলিশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুর ইউনিয়ন এলাকায় রাতের আঁধারে ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে এক গৃহবধূকে (৩৫) বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতন ও নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে স্থানীয় সন্ত্রাসী দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা। এর আগে দেলোয়ার ও তার সহযোগী কালাম ওই নারীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন।
গত ৪ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয় এবং দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় বইতে শুরু করে। ওই নির্যাতন ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী বাদী হয়ে গত ৪ অক্টোবর বেগমগঞ্জ মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পর্নোগ্রাফী আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় দোলোয়ার বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড নুর হোসেন বাদলসহ ১৪ জনকে আসামি করা হয়।
৬ অক্টোবর বাহিনী প্রধান দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ওই নারী আরও একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ও র্যাব অভিযান চালিয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও বেগমগঞ্জ থেকে দেলোয়ারসহ মামলার আট আসামিকে এবং এজাহার বহির্ভূত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন আট জন। তারা হচ্ছেন- আব্দুর রহিম, মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগ, আনোয়ার হোসেন সোহাগ, নুর হোসেন রাসেল, মাঈন উদ্দিন সাহেদ, নুর হোসেন বাদল, মো. মহিন উদ্দিন সাজু ও আবুল কালাম। এ ঘটনার মূল হোতা বাহিনী প্রধান দেলোয়ার বর্তমানে পুলিশের রিমান্ডে রয়েছেন।
বেগমগঞ্জের এ ন্যক্কারজনক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই জেলার সেনবাগ ও চাটখিল উপজেলায় এক অন্তঃসত্ত্বাসহ দুই গৃহবধূকে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করার অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনের শিকার দুই নারী ধর্ষণের ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
গত ৯ অক্টোবর সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়ন এলাকায় তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীকে (২০) রাতের আঁধারে ঘরে ঢুকে স্থানীয় বখাটে সন্ত্রাসী পারভেজের (২৫) নেতৃত্বে সাত-আট জন যুবক ধর্ষণ করে। এ সময় ধর্ষণকারীরা ওই নারীর ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ধর্ষণের ভিডিও ঐ নারীর স্বামীর মুঠোফোনে পাঠিয়ে দেয় ধর্ষণকারীরা। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ১০ অক্টোবর সকালে ঐ নারীর স্বামী তাকে বাড়ী থেকে বের করে দেন। থানায় অভিযোগ দেওয়া হলে পুলিশ তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। তবে ধর্ষণ ঘটনার মূল হোতা পারভেজকে রহস্যজনক কারণে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
২১ অক্টোবর ভোর রাতে চাটখিল উপজেলার নোয়াখলা ইউনিয়ন এলাকায় এক প্রবাসীর স্ত্রীর (২৯) ঘরের দরজা কৌশলে খুলে ঘরে ঢুকে গৃহবধূর দুই শিশু সন্তানের গলায় অস্ত্র ধরে তাকে ধর্ষণ করেন স্থানীয় নোয়াখলা ইউনিয়ন যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃত নেতা মজিবুর রহমান শরীফ। এ সময় ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও ধারণ ও ঐ নারীকে বিবস্ত্র করে ছবি তোলেন শরীফ।
এ ঘটনায় ২১ অক্টোবর দুপুরে শরীফের বিরুদ্ধে চাটখিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী নারী। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই দিন দুপুরেই শরীফকে গ্রেপ্তার করে। রাতে শরীফকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে তার আস্তানা থেকে বিদেশি পিস্তল, গুলি ও জন্ম নিরোধক সামগ্রী উদ্ধার করে পুলিশ।
২৭ সেপ্টেম্বর কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহী ইউনিয়নের চর ফালুয়া গ্রামের সামছুল হকের ছেলে জয়নাল আবেদীন (২২) জোরপূর্বক ১০ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে।
৪ অক্টোবর রাতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর ফকিরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাজহারুল হকের ছেলে ইমন হোসেন (২২) মোবাইল ফোনের সম্পর্কের জের ধরে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলা থেকে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীকে দেখা করার কথা বলে কোম্পানীগঞ্জ নিয়ে আসে। এরপর সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ঐ তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে।
এ ঘটনায় এলাকাবাসী চার ধর্ষক ও মেয়েটিকে আটক করে থানা পুলিশে সোপর্দ করলেও পুলিশ ধর্ষক ও ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ৫৪ ধারায় আদালতে প্রেরণ করে। বিষয়টি আদালতের সন্দেহ হলে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আদালত তলব করেন।
প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে ১০ অক্টোবর রাতে সুবর্ণচর উপজেলার মধ্য বাগ্গা গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে মো. বাবুল (২০) কবিরহাট উপজেলার ২১ বছর বয়সী এক তরুণীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় গত ১১ অক্টোবর কবিরহাট থানায় একটি মামলা দায়ের হয়।
২১ অক্টোবর রাতে কোম্পানীগঞ্জের চর ফকিরা ইউনিয়নের চরকালী গ্রামের আবু বকর ছিদ্দিকের ছেলে রুহুল আমিন হেলাল (৩২) সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়ার কথা বলে ২১ বছর বয়সী এক নারীকে বসুরহাট পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় ২২ অক্টোবর থানায় মামলা দায়ের হলে পুলিশ ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে।
২১ অক্টোবর দুপুরে সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বার ইউনিয়নের চরহাসান গ্রামের বাসিন্দা মৃত দায়মুদ্দিনের ছেলে আব্দুল হক কাজী (৫৫) বিস্কুট দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে বসত ঘরে নিয়ে শিশু শ্রেণীর এক ছাত্রীকে (৭) ধর্ষণ করে রক্তাক্ত করেন। শিশুটির পরিবার ঘটনাটি স্থানীয় ইউপির সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ফাজিলাতুন নেছা ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে জানালে তারা স্থানীয় পর্যায়ে ঘটনাটি মীমাংসা করে দেওয়ার কথা বলে মামলা করতে বাধা দেন। পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলামের সহযোগিতায় ২২ অক্টোবর রাতে শিশুটির বাবা চরজব্বার থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের তিন দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ ধর্ষককে গ্রেপ্তার করেনি।
২১ অক্টোবর দুপুরে চাটখিল উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের করটখিল গ্রামের মনির হোসেনের ছেলে মো. মিরাজ হোসেন (১৮) এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুকে (১০) ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় ২৪ অক্টোবর দুপুরে চাটখিল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ধর্ষক পলাতক রয়েছে।
২৩ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় এক নারীর (২৫) বসত ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ধর্ষকের সহযোগিতা করেন তার বন্ধু মাসুদ উদ্দিন। গত শনিবার রাতে এ ঘটনায় ধর্ষণের শিকার নারী বাদী হয়ে হাতিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ধর্ষক ট্রপেল দাস নয়নকে (২৮) গ্রেপ্তার করে।
বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুর এলাকায় ২৪ অক্টোবর গভীর রাতে ১৬ বছর বয়সী এক শিশুর ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে ধর্ষণ করে স্থানীয় বখাটে যুবক সুমন (৩২)। ধর্ষক সুমন করিমপুর মহল্লার কামাল হোসেন হুক্কা মিয়ার ছেলে। এ ঘটনায় ধর্ষণের শিকার শিশুর পিতা বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় গত শনিবার সন্ধ্যায় একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ধর্ষক সুমনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করে।
নারী অধিকার জোট নোয়াখালী জেলা সভাপতি লায়লা পারভিন সম্প্রতি নোয়াখালীতে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘যারা ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হওয়া, দ্রুত বিচার না হওয়া, এসব ঘটনায় প্রভাবশালীদের ভয়ে সাক্ষী না দেওয়া, অধিকাংশ ঘটনা শালিস বৈঠকের মাধ্যমে মীমাংসা হওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে মেডিকেল রিপোর্ট পাল্টে দেওয়া এর জন্য দায়ী। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ঘটনা প্রতিরোধে নির্যাতনের প্রমাণ ও আলামত সংরক্ষণের সু-ব্যবস্থা ও গভীর নজরদারি বাড়াতে হবে।’
নোয়াখালী এনআরডিএস (নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির) এর নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী আব্দুল আউয়াল নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন মোকাবিলা করার জন্য যে সামাজিক শক্তি প্রয়োজন তা বর্তমান সমাজে দৃশ্যমান নয়। এটা সার্বিক ব্যর্থতার চিত্র। এর কারণ সমাজের আইনশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা সমাজের কিশোর অপরাধ ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের মাঝে একধরনের শক্তির যোগান দেয়। যার কারণেই ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের দ্রুত ধর্ষণ ও সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
নোয়াখালী পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় থানা পুলিশে অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনছে। যার প্রমাণ বেগমগঞ্জের একলাশপুরের নারী নির্যাতনের ঘটনা। পুলিশ নারী নির্যাতনকারী ও ধর্ষকদের সঙ্গে কোনো আপোষ করছে না। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসামীদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করছে। এছাড়া জেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে জেলার ৯টি উপজেলায় প্রতি রাতেই পুলিশের বিশেষ অভিযান চলমান রয়েছে। পুলিশ অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় দেখে না। অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে শান্তি নিশ্চিত করতে পুলিশ কাজ করছে।
Comments