চীন-ভারত উত্তেজনা: লাদাখ সীমান্তে বাণিজ্যে স্থবিরতা
চীন-ভারতের সম্মতির পর লাদাখ অঞ্চলে গত কয়েক দশকে সচল হয়ে উঠেছিল ‘সিল্ক রোড’ হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক বাণিজ্যপথটি। তবে প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা বাধাগ্রস্ত করে তুলছে সেই সীমান্ত বাণিজ্যকে।
চীনের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে আজ সোমবার এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, বিগত বছরগুলোর মতো এবারের শীত স্থানীয় ব্যবসায়ী গিয়ালসনের (৪৭) জন্যে কোনো সুসংবাদ বয়ে আনছে না। লাদাখ অঞ্চলে চীন সীমান্তের কাছে ভারতীয় গ্রাম ডেমচকের বাসিন্দা তিনি।
সুউচ্চ পর্বতের কোলে এই গ্রামে শীতকালে তাপমাত্রা মাঝেমধ্যে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়। তবে তাদের কাছে শীত মানেই ব্যবসার সুযোগ। প্রচণ্ড তুষারপাত ও ভূমিধসের কারণে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে লাদাখের রাজধানী শহর লেহ’র সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীদের তাকিয়ে থাকতে হয় পূবে- চীনের দিকে।
প্রায় ৫০ বছর হতে চলছে ভারত ও চীন তাদের সীমান্ত বন্ধ রেখেছে। একবার যুদ্ধও হয়েছে দেশ দুটির মধ্যে। তারপরও লাদাখ অঞ্চলে ঐতিহাসিক ‘সিল্ক রোড’ কখনোই বন্ধ হয়নি। বরং সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ক্রমাগত বেড়েছে।
গিয়ালসনের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সিন্ধু নদ। নিয়ম করে তিনি শুকনো ফল, আটা, মসলা, চাল ও পশমি সুতার বস্তা পশুদের পিঠে চাপিয়ে সেই নদ ও সীমান্ত পার হয়ে যেতেন চীনে। গত কয়েকমাস ধরে তিনি তার বুনো ষাঁড় ও ঘোড়াগুলোকে পুষ্ট করছেন আসছে শীতে বাণিজ্যযাত্রায় যাওয়ার জন্যে।
পুরো নাম উল্লেখ না করার শর্তে গিয়ালসন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এপার থেকে পণ্য নিয়ে ওপারে ডুমচেলে এলাকায় যেতে একদিন সময় লাগে। সেখানে বণিকরা তাদের পণ্য এনে রাখেন। পণ্যবিনিময় প্রথার মাধ্যমে কেনা-বেচা হয়। সেখান থেকে নতুন পণ্য পশুর পিঠে চাপিয়ে আমাদের গ্রামে নিয়ে আসি।’
গিয়ালসনের সেই নতুন পণ্যের তালিকায় থাকে কার্পেট, জামা-জুতা, কম্বল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী।
গ্রীষ্মে সমস্ত লাদাখ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে গিয়ালসন শীতে সেগুলো বিক্রি করেন চীনে। বিনিময়ে পাওয়া চীনা পণ্য তিনি বিক্রি করেন লেহ শহরের খুচরা বাজারে। গিয়ালসনের মতো আরও অনেকেই এভাবে জীবন কাটান। গত কয়েক দশকে এতে কোনো বাধা আসেনি।
কিন্তু, এ বছর যেন সবকিছু বদলে গেছে। গত জুনে লাদাখ অঞ্চলে চীন-ভারত সীমান্তে সেনারা সংঘাতে লিপ্ত হওয়ায় উভয় দেশ সেখানে সেনা ও অস্ত্রের সংখ্যা বাড়িয়েছে। ফলে শীত এগিয়ে এলেও সীমান্ত বাণিজ্যের সম্ভাবনা এবার নেই বললেই চলে।
অপর এক ব্যবসায়ী দর্জি (৩৮) বলেন, ‘সেনারা আমাদের সীমান্ত থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। কোনো অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যও এবার চলবে না বলে তারা জানিয়ে দিয়েছেন।’
শীতে তার ৫ লাখ ভারতীয় রুপি আয় হয় উল্লেখ করে দর্জি জানান, এ দিয়ে সারা বছর তিনি পরিবারের খরচ মেটান।
লাদাখ সীমান্তে বাণিজ্য এতোটাই বেড়েছে যে চীনা ব্যবসায়ীরা ট্রাকে করে পণ্য নিয়ে সীমান্তে আসেন। সেখানে একটি অস্থায়ী সেতু তৈরি করা হয়েছে। ফলে সীমান্ত বাণিজ্য প্রায় সারা বছর চলে।
গিয়ালসনের মতে, লাদাখে এসে পর্যটকরা তুলনামূলক কম দামে চীনা পণ্য কিনেন।
লাদাখের সাবেক শুল্ক কর্মকর্তা রমেশ ভট্টাচার্য জানান, ২০০৩ সালে তিনি যখন সেখানে কর্মরত ছিলেন তখন প্রায় ৩০ কোটি রুপি বাণিজ্য হতো। এখন তা অনেক গুণ বেড়েছে।
সীমান্ত সংঘাতের ফলে এখন থেমে গেছে লাদাখের সেই বাণিজ্য। একজন সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা বলেন, যে ডুমচেলেতে ব্যবসায়ীরা এসে জড়ো হতেন তা এক সময় ভারতীয় অংশে ছিল। এখন তা চীনের নিয়ন্ত্রণে।
গিয়ালসনের মতে, ‘সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ায় আমাদের জীবন জটিল হয়ে গেছে। কেননা, বাণিজ্য করেই আমরা জীবন চালাতাম।’
Comments