ট্রাম্প না বাইডেন, কে জিতবেন?

বাংলাদেশি-আমেরিকানদের পর্যবেক্ষণ
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন।

‘ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হবেন অর্থনীতির কারণে। এতকিছুর মধ্যে ট্রাম্প আমেরিকার অর্থনীতি ঠিক রাখতে সক্ষম হয়েছেন। করোনা মহামারির কারণে মানুষ কাজ হারিয়েছে, এটা সত্য। আবার কাজ ফিরে পেয়েছে, পাচ্ছে— এটাও সত্য। আমি নিজেই কাজ ফিরে পেয়েছি। ট্রাম্প একজন সফল ব্যবসায়ী বলেই আমেরিকার অর্থনীতি ঠিক রাখতে পেরেছেন। জনমত জরিপ সঠিক হবে না। যেমন সঠিক হয়নি গত নির্বাচনে। ট্রাম্প গণমাধ্যমকে গুরুত্ব দেন না। সে কারণে গণমাধ্যম তার বিরুদ্ধে এসব জরিপ হাজির করছে। পপুলার ভোটের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ২৭০টির চেয়ে বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ট্রাম্প পাবেন’, বলছিলেন মেরিল্যান্ডের বাসিন্দা বাংলাদেশি-আমেরিকান ড্যানিশ রোজারিও।

জো বাইডেনের বিজয়ের বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ওকলাহোমার বাসিন্দা বাংলাদেশি-আমেরিকান মাহমুদ শাহ আশরাফের। ‘ট্রাম্প আমেরিকার অর্থনীতিকে অত্যন্ত দুর্বল করে দিয়েছে। ট্রাম্পের নীতিতে লাভবান হয়েছে অল্প কিছু সংখ্যক বড় ব্যবসায়ী। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ট্রাম্পের উদ্ভট কথা ও আচরণে আমেরিকানরা বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। জনমত জরিপে ট্রাম্প যে আট থেকে দশ পয়েন্টে পিছিয়ে আছেন, সেটা তারই প্রমাণ। ট্রাম্পের তুলনায় জো বাইডেন যে খুব যোগ্য প্রার্থী, তা হয়তো নয়। কিন্তু, আরও চার বছর ট্রাম্পকে মানুষ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায় না। পপুলার ভোট হিলারি যেমন বেশি পেয়েছিলেন, জো বাইডেন তারচেয়ে বেশি পাবেন। আর ইলেকটোরাল কলেজ ভোট দরকার ২৭০টি। এখনকার হিসেব অনুযায়ী ডেমোক্রেটরা পাবেন ২৯০টি। তবে, এই সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছি’, যোগ করেন মাহমুদ শাহ আশরাফ।

একই বিষয়ে ড্যানিশ এবং আশরাফের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান। আর এই অবস্থান বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। যা আমেরিকার সমাজ-রাজনীতির বাস্তব চিত্র। আমেরিকার জনগণ তীব্রভাবে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান, এই দুই শিবিরে বিভাজিত-বিভক্ত। পরিবেশ পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তারা দলের পক্ষে ভোট দেন। ডেমোক্রেটরা নিজ দলের প্রার্থী বা প্রেসিডেন্টের কোনো স্খলন মেনে নিতে চান না, রিপাবলিকানরা আবার স্খলনকে গুরুত্ব দেন না, আমেরিকান সমাজে প্রচলিত ধারণা এমনই।

‘অন্য যে কোনোবারের চেয়ে এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট একটু আলাদা। প্রচলিত ধারণা নিয়ে এবারের নির্বাচন বিশ্লেষণ করা যাবে না। অনেক রিপাবলিকান সমর্থকও এবার ডেমোক্রেট প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিবেন। কারণ ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে তারাও ক্ষুব্ধ। জো বাইডেনই জিতবেন’, নিশ্চিত করে বলছিলেন জাকারিয়া মাসুদ জিকো। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত আজকাল পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক এবং জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া মাসুদ মনে করেন, ‘ট্রাম্পের নীতির কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অল্প কিছুসংখ্যক বড় ব্যবসায়ী ছাড়া অধিকাংশই তাকে ভোট দিবে না। আমেরিকার তরুণ ভোটাররা তাকে ভোট দিবে না, অসত্য কথা ও উদ্ভট আচরণের কারণে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তার সীমাহীন ব্যর্থতায় সিনিয়র সিটিজেনরা তার ওপর বিরক্ত। ফ্লোরিডার মতো সিনিয়র সিটিজেনদের বসবাস করা রাজ্যগুলোতে ট্রাম্প এবার বিজয়ী হতে পারবেন না।’

‘আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন, আমেরিকানরা এটা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। নির্বাচনে যা প্রভাব ফেলবে। চীনে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকার বিষয়টিও তার জন্যে নেতিবাচক হয়েছে। গত নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে  হিলারি ক্লিনটনের ইমেল কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছিল। যার সুবিধা পেয়েছিলেন ট্রাম্প। এবার তেমন কিছু নেই। উল্টো ট্রাম্পের নানা কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হচ্ছে। আগাম ভোটের রেকর্ড হচ্ছে, যা ট্রাম্পের বিপক্ষে যাবে’, বলছিলেন জাকারিয়া মাসুদ জিকো।

আমেরিকান সমাজ-রাজনৈতিক বিভাজন বা বিভক্তি বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা বাঙালীর সম্পাদক ও লেখক কৌশিক আহমেদ। ‘আমেরিকার সমাজ-রাজনীতির এই বিভাজন নতুন নয়, বহু পুরনো। আগে দৃশ্যমান ছিল না, এখন দৃশ্যমান হয়েছে। যে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী যারা নিজেদের পিওর আমেরিকান মনে করেন, তাদের ভেতরে একটা পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জমা হয়েছিল দীর্ঘ বছর ধরে। তারা মনে করত সবকিছু  অভিবাসীদের দখলে চলে যাচ্ছে। গত নির্বাচনের আগে ট্রাম্প যখন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিলেন, তখন তাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ দৃশ্যমান হলো। আমেরিকান সমাজের বিভাজন প্রবলভাবে দৃশ্যমান হলো’, বলছিলেন কৌশিক আহমেদ।

জনমত জরিপে জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও ডেমোক্রেটিক সমর্থক কৌশিক আহমেদ বিজয়ের বিষয়ে নিশ্চিত নন। ‘সমগ্র আমেরিকায় কৃষকদের বসবাস শহরের বাইরে। তারা শ্বেতাঙ্গ এবং কট্টর রিপাবলিকান সমর্থক। জনমত জরিপে সাধারণত তাদের মতামতের প্রতিফলন থাকে না। ট্রাম্প যা কিছুই করুক না কেন, তারা ভোট ট্রাম্পকেই দিবে বলে ধারণা করা হয়। সে কারণে ফলাফল বিষয়ে নিশ্চিত মন্তব্য করা যাবে না’, যোগ করেন বাঙালী সম্পাদক।

ফিলাডেলফিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশি-আমেরিকান মোহাম্মেদ আলম বকুল বলছিলেন, ‘কোনো বিবেচনাতেই নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, কে বিজয়ী হবেন। ফিলাডেলফিয়া শহরাঞ্চলে জো বাইডেনের অবস্থান ভালো বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। আমি ডেমোক্রেট সমর্থক। ভোট বাইডেনকে দেবো। শহরের বাইরে পেনসিলভেনিয়ার যে বৃহৎ শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের বসবাস, তাদের একচেটিয়া ভোট পাবেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের নানাবিধ কেলেঙ্কারি ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্যর্থতা, এসব ভোটারদের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।’

‘গত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, ডেমোক্রেট সমর্থকরা এবার অত্যন্ত সচেতন’, বলছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফ্লোরিডার প্রেসিডেন্ট এম রহমান জহির। তার পর্যবেক্ষণ, ‘ফ্লোরিডার স্মৃতি ডেমোক্রেটদের জন্যে স্বস্তিদায়ক নয়। ২০০০ সালে আল গোর মাত্র ৫৪০ ভোটে পরাজিত হয়ে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ফ্লোরিডায় জিততে পারেননি হিলারিও। তবে, ফ্লোরিডায় এবার ডেমোক্রেটদের অবস্থান অত্যন্ত সংহত ও স্বস্তিদায়ক। আমেরিকার তরুণরা মিথ্যা বলা পছন্দ করে না। গত নির্বাচনের আগে হিলারির ইমেল কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর আমার কলেজ পড়ুয়া ছেলে বলল, “হিলারি মিথ্যা বলছে। তাকে পছন্দ করা যাবে না।” মিথ্যা বলা ও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার কারণে তরুণদের ভোট হারাবে ট্রাম্প। আবহাওয়া-জনিত সুবিধার কারণে আমেরিকার সিনিয়র সিটিজেনদের প্রিয় ফ্লোরিডা। কোভিড-১৯ মোকাবিলা করতে না পারায় তারা ট্রাম্পকে ভোট দিবে না। এদের মধ্যে যারা রিপাবলিকান সমর্থক, তাদেরও অনেকে এবার জো বাইডেনকে ভোট দিবে। ট্রাম্প সমর্থকরা ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানোর পথ বেছে নেওয়ায় আগাম ভোট দিচ্ছে ভোটাররা। যা ট্রাম্পের বিপক্ষে, বাইডেনের পক্ষে যাচ্ছে। এ কারণে ডাকযোগে আগাম ভোট দেওয়ার বিরোধিতা করছেন ট্রাম্প। ফ্লোরিডায় এবার ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর ফ্লোরিডায় বিজয় ছাড়া তার পক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাওয়া সম্ভব নয়।’

নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে কর্মরত শহিদুল ইসলাম মনে করেন, ‘ট্রাম্পের তুলনায় জো বাইডেন অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ট্রাম্প যা করেছেন-যা বলেছেন, তাতে আমেরিকানরা হতাশ এবং বিক্ষুব্ধ হয়েছে। এবার আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোট পড়তে পারে। ২০১৬ সালে ভোট পড়েছিল ১৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি। এবার ১৫ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। ডাকযোগে আগাম ভোট তো রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ইতোমধ্যে। যত বেশি ভোট পড়বে, জো বাইডেনের জেতার সম্ভাবনা তত জোরাল হবে। আমেরিকার নির্বাচনে বিতর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেই বিতর্কেও ট্রাম্প পিছিয়ে আছেন জো বাইডেনের কাছে। ট্রাম্পের একেক সময় একেক রকম কথায় সারা পৃথিবীতে আমেরিকার ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রাম্পের ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়টিও ভোটারদের প্রভাবিত করবে।’

যদিও ড্যানিশ রোজারিওর দাবি, ‘আমেরিকানরা মনে করেন, প্রচলিত সিস্টেমের সুযোগ নিয়েছেন ট্রাম্প। এটা কোনো অন্যায় বা অপরাধ না। আমেরিকানরা মনে করেন, সুযোগ থাকলে যে কেউ ট্যাক্স ফাঁকি দিবেই। তা ছাড়া, ট্রাম্পকে আমেরিকানরা রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখেন না, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে দেখেন। তিনি এমন ভাবমূর্তি তৈরি করে নিয়েছেন যে, যা মনে আসে তিনি তা বলে দেন। কোনো রাখঢাক করেন না। ট্রাম্পের এসব কথায় আমেরিকানরা কিছু মনে করেন না।’

সম্পাদক কৌশিক আহমেদের বিশ্লেষণ, ‘জো বাইডেন যদি বড় ব্যবধানে বিজয়ী না হন, ফলাফল যদি কাছাকাছি হয়, তবে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না ট্রাম্প। তিনি নির্বাচনকে আদালতে নিয়ে যাবেন এবং সেখানে তিনি ইতোমধ্যে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছেন। আদালতে গেলে প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় ফল ট্রাম্পের পক্ষে যাবে।’

Comments

The Daily Star  | English

UN says cross-border aid to Myanmar requires approval from both govts

The clarification followed Foreign Adviser Touhid Hossain's statement on Sunday that Bangladesh had agreed in principle to a UN proposal for a humanitarian corridor to Myanmar's Rakhine State

2h ago