জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার বর্ণনা দিলেন পাটগ্রামের ওসি

OC Suman.jpg
পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন কুমার মহন্ত। ছবি: স্টার

‘পুলিশ ১৭ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়েছিল। কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু তবুও উপস্থিত জনগণের উন্মত্ততা থামছিল না। পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছিল, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।’

‘উন্মত্ত জনতা ইচ্ছামতো পাথরের ঢিল ছুড়তে থাকে। আমার শরীরেও অসংখ্য পাথরের ঢিল পড়েছে। একসময় আমিও মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তবুও আমাকে কিছু করতে হবে, তাই সাহস নিয়ে ঘটনাস্থলে অবস্থান করি।’

এভাবেই লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী বুড়িমারী বাজারে আবু ইউসুফ শহিদুন্নবী জুয়েল (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন কুমার মহন্ত।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘সেদিন ঘটনাস্থলে প্রায় ৫-৬ হাজার জনতার ভিড় ছিল, আর সবাই স্লোগান দিচ্ছিল, মেরে ফেলো, ওকে মেরে ফেলো।’

ওসি সুমন বলেন, ‘ঘটনাস্থলে উপস্থিত ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানসহ মেম্বাররা যখন জীবন বাঁচাতে ভবনের বাইরে চলে যান, তখন আমি ভিকটিমের রুমে যাই। ততক্ষণে গ্রিল, দেয়াল ভেঙে “মের ফেলো, মেরে ফেলো” শ্লোগান দিতে দিতে লোকজন ইউপি ভবনে ঢুকতে শুরু করেছে। আমি গিয়ে দেখি একজন দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যজন ফ্লোরে শুয়ে পড়ে আছেন, আর তাকে ইচ্ছামতো পেটানো হচ্ছে। আমি দাঁড়ানো জনকে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসি। তখন পেছন থেকে আমাকে মারা হচ্ছিল।’

‘তবু দ্রুত ভবনের দোতলায় উঠে যাই। গ্রিল টপকে চালের ওপর দিয়ে আরেকটি মার্কেটের ছাদ দিয়ে পালিয়ে অন্য একটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসি। দ্রুত বাজারের ভেতর ঢুকে দৌড়ে সামনে যাই, পরে একজনের বাইকে করে পুলিশ টিমের সঙ্গে মিশে যাই’, যোগ করেন তিনি।

ওসি সুমন বলেন, ‘আমার শরীরে এতো পাথরের ঢিল ও লাঠির আঘাত পড়েছিল, তারপরও একজনের প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি, এটিই আমার কাছে শান্তির। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আর একটি প্রাণ বাঁচাতে পারিনি।’

গত ২৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিকালে মসজিদে তর্কাতর্কির জেরে শহিদুন্নবী জুয়েল ও তার সঙ্গী সুলতান রুবাইয়াত সুমনকে পিটিয়ে যখন বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে নেওয়া হয়, তখন গোলযোগের খবর পেয়ে ফোর্স নিয়ে ছুটে যান ওসি সুমনও।

‘আমি সেদিন বিকাল ৫টা ১মিনিটে খবর পাই। তখনই আমি বুড়িমারী জিরো পয়েন্ট থেকে আট জনের পুলিশ ফোর্স পাঠাই। আমি আরও দশ জন ফোর্স নিয়ে সেখানে পৌঁছাই’, বলেন তিনি।

ওসি বলেন, ‘আমার থানায় ৬৪ জন ফোর্স। এমপি ডিউটি, অন্যান্য ডিউটি ও ছুটি মিলিয়ে ৩২ জনকে আমি কখনই পাই না। যানবহনেরও সংকট আছে।’

‘এই ধরনের ঘটনা ঠেকানোর মতো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। আমরা ঘটনা শুনে এসেছিলাম। কিন্তু হরতাল-অবরোধ মোকাবিলায় তো না, তাই আমাদের গ্যাস, গান বা অন্য প্রস্তুতি ছিল না’, বলেন ওসি।

তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি শুরুতেই থামানো যেতো। স্থানীয়রা বিষয়টি মসজিদে মিটিয়ে দিয়ে লোক দুটোকে পাঠিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তারা ইউপি কার্যালয়ে আটকে রেখে সময়ক্ষেপণ করেছেন এবং লোক জমায়েত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। পরে তারা আর সামলাতে পারেননি।’

২৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে পবিত্র কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পাটগ্রাম থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে।

নিহতের চাচাত ভাই সাইফুল আলম করেছেন হত্যা মামলা, পুলিশের পক্ষে এসআই শাহাজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত করেছেন সরকারি কাজে বাধা, অগ্নি সংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় অপর দুটি মামলা।

এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৪ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১২ জন হত্যা মামলার আসামি আর বাকি ১২ জন অপর দুই মামলার আসামি।

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

4h ago