একজন স্বাপ্নিক মানুষ ও একটি হারানো রাজ্য

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে ও ভারতের মেঘালয়ের খাসি পাহাড়ের পাদদেশে এক স্বপ্নদর্শী নেতার সমাধি আছে। যিনি তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বপ্ন দেখেছেন একটি স্বাধীন রাজ্যের।
উইক্লিব সিম। ছবি: সংগৃহীত

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে ও ভারতের মেঘালয়ের খাসি পাহাড়ের পাদদেশে এক স্বপ্নদর্শী নেতার সমাধি আছে। যিনি তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বপ্ন দেখেছেন একটি স্বাধীন রাজ্যের।

দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলো তার রাজ্য, কিন্তু দ্রুতই সে রাজ্য হয়ে যায় ভারতীয় আধিপত্যের অংশ। আর তাকে করা হয় নির্বাসিত।

তিনি উইক্লিব সিম। বর্তমান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ওয়েস্ট খাসি হিলস জেলার হিমা নংস্তৈন (নংস্তৈন রাজ্য) এর খিন্নাহ বা উপ-রাজা।

নির্বাসিত জীবনে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নিজের রাজ্য বা ভারত শাসিত কোন ভূখণ্ডে তিনি পা রাখবেন না।

তার ছেলে এন্ড্রু সলমার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘উইক্লিব প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন, যদি নিজের রাজ্যে ফিরতে হয়, তবে বিজয়ীর বেশে স্বাধীন রাজ্যেই ফিরবো। বিদেশিদের অধীনে আত্মসমর্পণ করে বন্দি হতে নয়।’

উইক্লিব সিম স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: স্টার

তবে দেশভাগের মাধ্যমে সৃষ্ট বৃহৎ দুই রাষ্ট্রের আড়ালে তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়, সেইসঙ্গে তার স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও ভেঙে যায়।

নিজ জন্মভূমিতে না ফেরার প্রতিজ্ঞার পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে অনুমতি দেয় এখানে বসবাসের, আর নিজের রাজ্য ও সম্প্রদায়ের খুব কাছাকাছি থাকার ইচ্ছা নিয়েই তিনি বসতি স্থাপন করেন তাহিরপুর উপজেলার রাজাই গ্রামে।

এন্ড্রু বলেন, ‘তাহিরপুরের এই পাহাড়ি অঞ্চল ভূতত্ত্বগতভাবে খাসি পাহাড়েরই অংশ ছিলো। বাবার কাছে এ স্থানটি তার জন্মভূমির মতোই ছিলো। আর এখানেই আমার মাকে বিয়ে করে স্থায়ী হয়ে যান।’

ইতিহাসবিদ ডেভিড রিড সিমলিয়া তার প্রবন্ধ ‘কন্সটিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট ইন দ্য খাসি এন্ড জৈন্তিয়া হিলস ১৮২৪-১৯৫০’ এবং হেলেন গিরি সিম তার বই ‘খাসিজ আন্ডার ব্রিটিশ রুল’ এ দেশভাগের সময়কার খাসি রাজ্যগুলোর বিভিন্ন ঘটনার আলোকপাত করেছেন।

তারা উল্লেখ করেন, দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালের ৯ আগস্ট খাসি হিলসের ২৫টি খাসি রাজ্য ভারতের সঙ্গে স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

পি গ্রেসফুলনেস বোনি তার ‘অ্যান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হিস্ট্রি অব হিমা নংস্তৈন ইন দ্য কলোনিয়াল পিরিয়ড’ গবেষণা প্রবন্ধেও নানা ইতিহাসবিদ ও মৌলিক তথ্য-উপাত্তের আলোকে ভারতীয় উপমহাদেশের এই ক্ষুদ্র রাজ্যটির নানা পর্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন।

দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর, ২৫টি খাসি রাজ্যের মধ্যে ১৯টি রাজ্য একীভূতকরণের দলিলে (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করে ভারতীয় রাজ্যের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়।

তবে, ৬টি খাসি রাজ্য এ দলিলে স্বাক্ষর করেনি এবং তার মধ্যে নংস্তৈন ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

তাহিরপুর উপজেলার রাজাই গ্রামে উইক্লিব সিমের সমাধি। ছবি: স্টার

নবগঠিত এ রাজ্যে উইক্লিব সিমের মামা রাজা সিব সিং সিম রাষ্ট্রপ্রধান এবং উইক্লিব সিম রাজ্য সচিব হিসেবে নির্বাচিত হন।

খাসি ভূমির ইতিহাসের উপর লিখিত ইতিহাসবিদ আই নোংগব্রির বই ‘কা হিস্টোরি কা রি হায়নিউইট্রিপ’তে লিখেছেন খাসি রাজ্যগুলোকে একীভূতকরণের দলিলে স্বাক্ষর করাতে আসাম সরকারের এক প্রতিনিধি সৈন্যবাহিনী নিয়ে খাসি হিলসে আসেন ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ।

পরে ১৮ মার্চ তারা রাজা সিব সিং সিমকে আটক করে এবং তার পরদিন রাজাকে বাধ্য করেন একীভূতকরণের দলিলে স্বাক্ষর করতে। অন্য পাঁচটি রাজ্যকেও একইভাবে ভারতীয় অঙ্গরাজ্যভুক্ত করা হয়।

উইক্লিব সিম তখন রাজ্যর রাজধানী থেকে দূরে সীমান্তবর্তী মহেষখোলা (বর্তমান সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায় অবস্থিত) এলাকায় অবস্থান করছিলেন এবং এ সুযোগে তৎকালীন আসাম রাজ্য সরকার উইক্লিবের নংস্তৈনে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়।

রাজা সিব সিং সিমকে আটক করে একীভূতকরণ দলিলে স্বাক্ষর করার বিষয় জানতে পেরে ২০ মার্চ ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে একটি চিঠি লিখেন উইক্লিব।

চিঠির একটি অনুলিপি উইক্লিব সিমের ছেলে অ্যান্ড্রু সলমারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে দ্য ডেইলি স্টার।

এ চিঠিতে উইক্লিব প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে নংস্তৈন রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা করার বিষয়টি উল্লেখ করে অনুরোধ জানান, নংস্তৈন রাজ্যে আসাম সরকারের অবৈধ অনুপ্রবেশ ও কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় সরকার যেন আদেশ দেয়।

পরবর্তীতে নির্বাসিত নেতা হিসেবে ঢাকাতে অবস্থান নিয়ে বৈশ্বিক সমর্থনের লক্ষ্যে ২৪ মার্চ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ট্রিগভেলিকে একটি টেলিগ্রাম পাঠান বলে দ্য স্টেটসম্যানের ২৮ মার্চ সংখ্যায় একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

টি রেংগেইড তার ‘উ উইক্লিব সিম’ বইয়ে দাবি করেন, বৈশ্বিক সমর্থনের উদ্দেশে জাতিসংঘের সদর দপ্তরেও গিয়েছিলেন উইক্লিব।

তবে, শেষ পর্যন্ত উইক্লিবের একক স্বাধীকার সংগ্রাম ব্যর্থ হয় এবং নংস্তৈন ভারতের অঙ্গরাজ্যের অংশ হিসেবেই থেকে যায়।

একীভূতকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে খাসি রাজ্যগুলো কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ এবং বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে কর্তৃত্ব দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো রাজ্য ইন্সট্রুমেন্ট অব মার্জারে (Instrument of Merger) স্বাক্ষর করে পূর্ণাঙ্গভাবে ভারতের অংশ হয়নি।

উইক্লিবের জীবন

উইক্লিব সিম ১৯০৯ সালের ১৫ আগস্ট নংস্তৈনে জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৩৭ সালে গুজরাটের বরোদা কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে খাসি জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রথম প্রকৌশলী হন।

পরবর্তীতে লন্ডন থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে নিজ রাজ্যে ফিরে এসে ১৯৪০ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং উইং কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

নির্বাসিত হওয়ার পর উইক্লিব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ী হয়ে প্রকৌশলী হিসেবেই নিজের নতুন কর্মজীবন শুরু করেন বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান তার ছেলে এন্ড্রু সলমার।

এন্ড্রু বলেন, ‘সিলেটের ফেঞ্জুগঞ্জ সার কারখানা, চট্টগ্রামের মিতসুবিশি মোটর ফ্যাক্টরি, জয়পুরহাট সুগার মিলসহ নানা প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করেন তিনি।’

১৯৭১ সালে অবসরে যাওয়ার সময় তিনি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টেকেরঘাট চুনাপাথর প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

১৯৮৮ সালের ২১ অক্টোবর, নির্বাসিত জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নংস্তৈনের এই উপ-রাজা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী এই নেতা তার প্রতিজ্ঞায় অটল ছিলেন।

তার মৃত্যুর পর তাকে রাজাই গ্রামে সমাহিত করা হয়। তার এক স্ত্রী ও বংশধররা এই গ্রামেই বসবাস করছেন এবং অপর স্ত্রীর পক্ষের বংশধররা বর্তমানে মেঘালয়ে আছেন।

উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা খাসি রাজা তিরোত সিং ও খাসি মুক্তি সংগ্রামী উ কিয়াং নাংবাহ এর মতো উইক্লিব সিমও খাসি জাতিগোষ্ঠীর এক বিপ্লবী চরিত্র।

ইতিহাসবিদ ও নতুন প্রজন্ম তাকে হায়নিউইট্রিপ জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই বিবেচনা করে এবং প্রতিবছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে বিভিন্ন নংস্তৈন ও মেঘালয়ে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

12h ago