মিয়ানমারের নির্বাচন উৎসব

‘সেনাবাহিনী সুচির নীতি গ্রহণ করেনি, সুচি সেনাবাহিনীর নীতি গ্রহণ করেছে’

মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো আজ রোববার। নির্বাচনে ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনার সঙ্গে ভোট দিয়েছেন মিয়ানমারের জনগণ।
ভোট দিতে দীর্ঘ সারি ধরে মিয়ানমারের ভোটারদের অপেক্ষা। ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো আজ রোববার। নির্বাচনে ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনার সঙ্গে ভোট দিয়েছেন মিয়ানমারের জনগণ।

মিয়ানমারের এবারের নির্বাচনের সংবাদ জানতে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার হয়ে মিয়ানমারে গত প্রায় এক দশক ধরে কর্মরত শিহাব উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।

সারা দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোর ৬টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে দুপুর ১২টার মধ্যেই প্রায় শেষ হয়ে যায়। ভোটাররা ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভিড় জমান। নির্বাচন মিয়ানমারে উৎসবের মত। কোথাওই কোনও সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মিয়ানমারের পরিচিতি রোহিঙ্গাদের মধ্য দিয়ে। রোহিঙ্গা ও অন্যান্য কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর বিষয় ছাড়া মিয়ানমারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন রকম।’

নির্ধারিত বাক্সে ব্যালট ফেলছেন মিয়ানমারের একজন ভোটার। এবারের নির্বাচনেও অং সান সুচির দলের জয় লাভ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারে যাদের ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড বা এনআরসি আছে তারা সবাই ভোট দিতে পারেন। দেশটিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছাড়া আর প্রায় সবারই এনআরসি রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল শনিবার পুরো সন্ধ্যা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেও খুব একটা মানুষজনের ঘোরাফেরা দেখতে পাইনি। মনে হচ্ছিল পুরো শহর ঘুমোতে গেছে রাত ৮টার মধ্যেই। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ভেতরের উত্তেজনাকে চাপিয়ে রাখতে পারে এরকম জাতি আমি কোথাও দেখিনি। তারা এমন না যে নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনও আগ্রহ নাই। প্রচুর আগ্রহ আছে, সবাই ভোট দিতে যায়। অনেকে আগেই ভোট দিয়ে ফেলেন। ষাটোর্ধ ভোটারদের বাড়ির কাছাকাছি ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছে আরও কয়েকদিন আগেই।’

মিয়ানমারে যাদের এনআরসি আছে তাদের প্রায় সবাই ভোট দেন। আগ্রহের পাশাপাশি ভোট দিতে যাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে- তাদের অনেকের মধ্যেই ভয় আছে ভোট না দিলে হয়তো তাদের কার্ড বাতিল করা হতে পারে। যদিও এ ধরনের কোনও আইন বা নিয়ম নেই বলেই জানান শিহাব উদ্দিন আহমেদ।

এবারের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে করোনা মহামারির মধ্যেই। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গতকাল দেশটিতে নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হয়েছে এক হাজার ৭১ জন এবং মারা গেছে ২০ জন। এ পর্যন্ত দেশটির মোট করোনা সংক্রমণের সংখ্যা ৬০ হাজার ৩৪৮ জন এবং মোট মারা গেছে এক হাজার ৩৯৬ জন।

করোনার এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে ভোটারদের নিরাপত্তায় কেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে শিহাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই করোনার সময়ের জন্য একসঙ্গে ৩০ জনের বেশি মানুষকে ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সবকিছুর মধ্যেও তারা সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ এবং গণনা শেষ করবে।’

বাসার পাশেই ভোট কেন্দ্র। দীর্ঘ সারি পার করে মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়ে এসে নিজ বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে এভাবেই ছবি তোলেন একজন ভোটার। ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারের প্রধান রাজনৈতিক দল এনএলডি অং সান সুচির রাজনৈতিক দল। দলটি বর্তমানে মিয়ানমারে সরকার গঠন করে আছে। এবারের নির্বাচনেও অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন দলটিই জিতবে বলে মনে করছেন শিহাব উদ্দিন আহমেদ। দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুচির ব্যাপক সখ্যতা কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এবারও অং সান সুচির নেতৃত্বে এনএলডি ক্ষমতায় আসবে। তবে গত বারের মতো ল্যান্ড স্লাইড ভিক্টরি হয়তো তারা পাবে না। বিশেষ করে কয়েকটি এথনিক রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলো নির্বাচনে জিতবে বলে অনেকে মনে করছেন। গত নির্বাচনে রাখাইন ছাড়া বাকি ছয়টি রাজ্যে এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল।’

মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ বার্মিজ। জাতিগত হিসেবের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের হিসাব যোগ করলে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ এক রকমের চিন্তার। তাদের প্রায় সবাই ভোট দেবেন এনএলডিকে। ৮৫ শতাংশ বার্মিজ এবং বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ছাড়া বাকি ১৫ শতাংশ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর।

শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে রাখাইন, কাচিন ও শান রাজ্যে আঞ্চলিক দলের বিজয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি।’

তবে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনএলডি পাবে বলে জানান তিনি। মিয়ানমারে সরকার গঠনের জন্য হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের ৪৪০ আসনের মধ্যে ২২১টি পেতে হয় এবং হাউস অব ন্যাশনালিটিতে ২২৪ আসনের মধ্যে ১১৩টি আসন পাওয়া প্রয়োজন হয়।

দেশটিতে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা ইউএসডিপি। এনএলডির সঙ্গে এই দলটির সম্পর্ক ভালো। তাদের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক সহিংসতা নেই। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও তাদের মধ্যে কোনও ধরনের সহিংসতা হয়নি।

শিহাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সারা বিশ্ব যখন জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের বিজয়ী বক্তব্য শুনছিল, সেই সময় লাখো মানুষ মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে মাস্ক পরে ভোট কেন্দ্রগুলোর বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে। আমেরিকা যখন “লাল” রংকে “না” বলেছে মিয়ানমার তখন “লাল”কে গ্রহণ করেছে। তাদের কাছে “লাল” হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রতীক।  তবে সেই গণতন্ত্র কতটা সার্বজনীন সেটা আলাদা বিচার।’

মিয়ানমারের সেনা সদস্যরাও মূলত বার্মিজ। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সুচি এক সময় সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে ছিলেন দেশটির সেনাবাহিনীর। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদকে ঘিরেই তার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়। অথচ এখন সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গেই সুচির সখ্যতা অনেক বেশি। দেশটির রাজনীতির মেরুকরণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী এবং সুচি আরও কাছাকাছি আসছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচি এবং সেনাবাহিনীর নীতি এক। শিহাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সেনাবাহিনী সুচির নীতি গ্রহণ করেনি, সুচি সেনাবাহিনীর নীতি গ্রহণ করেছে।’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago