স্বাধীনচেতা সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি রাজশাহীর খুকি

দিল আফরোজ খুকি। স্টার ফাইল ছবি

নিজের সম্পদ নিঃস্বদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে, রাজশাহীর দিল আফরোজ খুকি সংগ্রামের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। ৩০ বছর ধরে তিনি শহরের পথে হেঁটে বিক্রি করছেন দৈনিক খবরের কাগজ। বয়স ষাটের কোঠায় পৌঁছে গেলেও তিনি এখনো সংবাদপত্র বিক্রি করেই সমাজসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিত্তশালী পরিবারে জন্ম বা নারী হওয়া তার সংগ্রামের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। শহরের শিরোইল এলাকায় তার বাড়ি। রোজ সকালে বাড়ির কাছের এজেন্টদের কাছ থেকে সংবাদপত্র সংগ্রহ করেন। সারাদিন ধরে তিনি শহরের পথে পথে ঘুরে সংবাদপত্র বিক্রি করেন। মাইলের পর মাইল হাঁটেন। তার কাঁধে ঝুলে থাকে একটি কাপড়ের ব্যাগ, যাতে থাকে নানান খবরের কাগজ ও ছোট বই।

কখনও কখনও, তিনি তার অভিজ্ঞতা নিয়ে, নৈতিকতা, মানুষের গুণাবলী নিয়ে এবং সক্রেটিস, গিরিশ চন্দ্র সেন এবং বেগম রোকেয়ার মতো মনিষীদের গল্প বলেন পথ চলতি লোকেদের। চলার পথে কারো অভাব দেখলে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সম্পদ বাড়িয়ে দেন। যাদের তিনি সাহায্য করেন তারা বেশিরভাগই অসহায় নারী। অনেককে নগদ অর্থ ঋণ দেন, সুদ দাবি করেন না। কখনো মিথ্যে বলেন না।

আত্মসম্মান এবং স্বনির্ভরতার জন্য তার এই সংগ্রাম খুব কমই তার কাছে ভালবাসার সাথে ফিরে আসে। উচিত কথা বলার জন্য, বেশভূষা ও সারল্যের জন্য অনেকে তাকে না বুঝেই ‘পাগলী’ বলে ডাকে, উপহাস করে। তিনি দমে যান না।

বয়স ষাটের কোঠায় পৌঁছে গেলেও দিল আফরোজ খুকি এখনো সংবাদপত্র বিক্রি করেই সমাজসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: স্টার

‘জন্ম নেওয়া সহজ, জীবন বড় কঠিন। জীবন একটি নৌকার মতো যাকে তার তীরের সন্ধান করতে হয়,’ খুকি কবিতার মতো আবৃত্তি করে ছন্দে ছন্দে বলেন।

‘আমি একটি জ্বলন্ত মোমবাতি কখন যে নিভে যাব জানি না। কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত জ্বলবো।’

তিনি বলেন, তিনি মানুষের কাছে খবরের কাগজ নিয়ে যান, যারা বেশিরভাগই আত্মমর্যাদার জন্য তার লড়াইয়ের কথা না জেনে খারাপ ব্যবহার করেন।

তিনি বলছিলেন, ‘আমি খবরের কাগজ বিক্রি করে নিজের জীবন চালাচ্ছি, এটা কি অসম্মানের? এটা কিভাবে অন্য কারো সম্মানহানি করে? কোনো কাজই ছোট নয়। অন্যের উপর নির্ভরশীল জীবন কষ্টের।’

পরিবারের সদস্যদের তথ্য অনুযায়ী, সাত বোন এবং পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে খুকি দশম। আশির দশকে টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে পড়াশুনা করেছেন। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল, বিধবাও হয়েছিলেন কম বয়সেই।

স্বামীর মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন খুকি। বিপর্যয় থেকে উঠে দাঁড়াতে দ্বিতীয় বিয়ে না করে স্বাবলম্বী হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন রাজশাহীভিত্তিক সাপ্তাহিক ‘দুনিয়া’ বিক্রি করা শুরু করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আহমেদ শফি উদ্দিন সাপ্তাহিকের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন। তিনি খুকির হকার হবার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন।

খুকির বোনের স্বামী আবদুল আজিজ তাকে আহমেদ শফি উদ্দিনের কাছে নিয়ে যান, খুকির জন্য একটি চাকরির অনুরোধ নিয়ে।

তিনি বলছিলেন, ‘খুকির বয়স তখন কুড়ির ঘরে। লিখতে জানতেন না বলে আমি তাকে তখন চাকরি দিতে পারিনি। রসিকতা করে তাদের বলেছিলাম যে আমি তার জন্য হকার হওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘কয়েকদিন পরই, খুকি আমাদের অফিসে এসে হাজির। বাঁচার জন্য চাকরিটা তার দরকার বলে জোর করতে থাকলেন। তিনি ২০ কপি দিয়ে শুরু করে সপ্তাহে ৫০০ কপি পত্রিকা বিক্রি করতে সময় নেননি। আমরা তাকে স্বর্ণপদক দিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে তিনি শহরের অন্যান্য স্থানীয় দৈনিক বিক্রি শুরু করেন।’

আহমেদ শফি উদ্দিন বলছিলেন, ‘খুকির আচরণ বুদ্ধিদীপ্ত, কথা বলেন সুন্দর করে গুছিয়ে, নিয়মানুবর্তিতার কারণে গ্রাহকরা তার কাছ থেকে কাগজ কিনতে পছন্দ করেন। তবে কম বয়সে রাস্তায় হয়রানি আর লাঞ্ছনাও মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। তবু দমে যাননি।’

রাজশাহী শহরের সংবাদপত্র হকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি জামিউল করিম সুজন জানান, খুকি এখনো প্রতিদিন তিন শতাধিক কপি খবরের কাগজ বিক্রি করেন। আগে আরও বেশি বিক্রি করতেন। এখন সংবাদপত্রের বিক্রি কিছুটা কমেছে। তিনি নগদ টাকা দিয়ে খবরের কাগজ কিনেন, কখনো বাকি রাখেন না। কারো কাছ থেকে সহায়তা নেন না, নেয়াটা অসম্মান বলে মনে করেন। বরং, তিনি যাদের প্রয়োজনে তাদের দান করেন।

এই প্রতিবেদক সম্প্রতি সাগরপাড়া এলাকায় খুকির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখেন তিনি ফুটপাতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। নিজের সেবা কার্যক্রম সম্পর্কে জানালেন, অসহায় অনেক নারীকে তিনি সেলাই মেশিন এবং তাদের স্বামীদের সাইকেল কিনে দিয়েছেন। এখনো নিয়মিত এতিমখানা, মসজিদ এবং মন্দিরে দান করছেন। বেশ কয়েকটি পরিবারকে স্বাবলম্বী হতে গবাদি পশু কিনে দিয়েছেন।

এর সবই করেছেন, সংবাদপত্র বিক্রির আয় আর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নিজের সম্পত্তি থেকে।

‘আমি যাদের দান করেছি তাদের বেশিরভাগের নাম মনে নেই। আজকাল, কোনো অভাবী ব্যক্তিকে খুঁজতে বেশি হাঁটতেও পারি না,’ নিজের দাতব্য কাজ সম্পর্কে জানান খুকি।

তিনি এই প্রতিবেদককে শিরোইল এলাকায় তার বাড়িতেও নিয়ে যান। তালা খুলে বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল সীমানা প্রাচীর ঘেরা একতলা বাড়িতে দুটি ঘর। পুরো বাড়িতেই আগাছা ভরা। তার মাঝেই ছড়িয়ে আছে সস্তা রঙবেরঙের ঘর সাজানোর সামগ্রী। অযত্নে অবহেলায় ঘরের ভেতরেও মলিনতার স্পষ্ট ছাপ।

তবে এসব নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। তার ভাষায়, ‘আমি এখানেই থাকি, পানির সংকট ছাড়া আমার আর কোনো সমস্যা নেই।’

এসময় খুকি আলমারি থেকে বের করে তার পুরানো দিনের কিছু ল্যামিনেটেড ছবি দেখান। একটি ছবিতে দেখা যায় খুকিকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন স্থানীয় একজন রাজনীতিবিদ। অন্যটিতে তাকে দেখা যায় তিনি একটি সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন।

নাহিদ আক্তার তানিয়া নামে এক প্রতিবেশী জানান, রাস্তার পাশের হোটেল থেকে খুকি তিন বেলা খাবার কিনে খান। তার যত্ন নেওয়ার মতো কেউ নেই। প্রতিবেশীদের বেশিরভাগই তার আত্মীয়, তবুও তারা খোঁজ রাখেন না। কোনো ধরনের সহায়তা নিতেও আত্মসম্মানে বাধে খুকির।

স্থানীয়রা জানান, খুকির কিছু আত্মীয় তাকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিল, তবে এলাকাবাসী তাকে এই বাড়িটি পেতে সহায়তা করেছিল। এমনকি এই বাড়িটিও বেদখলের চেষ্টার কথা জানান কয়েকজন প্রতিবেশী। তবে খুকির ভাগ্নে শামস-উর রহমান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ‘খুকির জন্য তার পরিবারের সদস্যরা বিব্রত। তিনি সহায়তা নেওয়া পছন্দ করেন না। অথচ প্রতিবেশীরা দেখেছে যে পরিবার তাকে সহায়তা করছে না।’

‘যখন তার সত্যিকারের প্রয়োজন হয় তখন পরিবারের সদস্যরাই তার যত্ন নেন, প্রতিবেশীরা তখন আসেন না।’

তিনি বলেছেন, গত বছরের শীতের সময় একদিন রাত দুইটায় ফোন পেলাম যে আমার খালা বিনোদপুর এলাকার রাস্তায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে। আমরাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তাকে খাবার দিলে আমাদের দেখিয়ে খাবারগুলো পুকুরে ফেলে দেন।

স্থানীয়রা জানান, খুকি তার আত্মীয়দের পছন্দ করেন না। আত্মীয়দের সম্পর্কে খুকি বলেন, আমি পেপার বেচি, এটা ওরা পছন্দ করে না। ওরা আমার সঙ্গে চলতে চায় না।

‘খুকি সংগ্রামী নারীদের প্রতিচ্ছবি, স্বাবলম্বিতা অর্জনের উদাহরণ। তার পুরো জীবন লোক দেখানো প্রচলিত সামাজিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বা সামাজিকভাবে তার যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে আমরা তার মধ্যে আরও শক্তিশালী এক নারীকে দেখা পেতাম,’ আহমদ শফি উদ্দিন বলছিলেন।

তিনি আরও বলেন, খুকির জন্য যদি একটা দোকানের ব্যবস্থাও করে দেওয়া যায় যেখানে তিনি বসে বসে বই, সংবাদপত্রের সঙ্গে অন্য কিছু বিক্রি করতে পারেন। এই পড়ন্ত বেলায় তিনি আর কত হেঁটে বেড়াবেন!’

খুকি বলেন, তার ইচ্ছা যে তার মৃত্যুর পর তাকে যেন কুষ্টিয়ায় দাফন করা হয় এবং তার সম্পত্তি কুষ্টিয়া জেলা শহরের একটি স্কুল ও হাসপাতালে দান করা হয়।

কিন্তু কিভাবে শেষ এই ইচ্ছা পূরণ করবেন তা জানেন না খুকি।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

1h ago