আলোকিত শিল্পী সৌমিত্র
কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু যেন দীপাবলি উৎসবের অনেক আলোর পরে নেমে আসা এক আকাশ অন্ধকার! তিনি ছিলেন আলোকিত অভিনয়শিল্পীর উদাহরণ! সবার প্রিয় অপু, ফেলুদা প্রায় ৪১ দিন ধরে যুদ্ধ করছিলেন হাসপাতালে। প্রতিদিন নতুন আলোর স্বপ্ন দেখাতেন তিনি।
গত ৬ অক্টোবর যখন করোনা আক্রান্ত হয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তখন থেকেই মন খারাপ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের। প্রাণ থেকে তাঁরা প্রার্থনা করে আসছিলেন প্রিয় অভিনেতার জন্য।
দর্শক নন্দিত এই অভিনেতা ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘অপুর সংসার’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। তারপর সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। শুধু সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনা নয় তপন সিনহা, মৃণাল সেন থেকে শুরু করে নতুন প্রজন্মের পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘হেমলক সোসাইটি’, গৌতম ঘোষের ‘দেখা’, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বেলা শেষে’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি।
চলচ্চিত্রের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে বারবার ভেঙেছেন, গড়েছেন। দর্শকের মনের ভেতর আবেগের এক নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তার অভিনীত আলোচিত সিনেমার অন্যতম সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’। এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯ সালে। এর মাধ্যমেই বড় পর্দায় হাতেখড়ি হয়েছিল তার। ‘অশনি সংকেত’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। এই ছবিতে তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের ববিতা।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে ববিতা বলেন, ‘সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অশনি সংকেত’ সিনেমায় অভিনয় করা ছিল আমার জীবনের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট। এতে অভিনয় করে আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হয়েছি। সৌমিত্র দার সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। যখনই বাংলাদেশে আসতেন আমাদের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সুন্দর সময় কেটেছে।’
১৯৬৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘চারুলতা’। এই ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৮ সালে। দিনেন গুপ্ত পরিচালিত ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। এই ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন অপর্ণা সেন।
১৯৬৩ সালে মুক্তি পেয়েছিলো ‘সাত পাকে বাঁধা’। এই ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সুচিত্রা সেন।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটা ১৯৭৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল। এতে তাকে ফেলুদার চরিত্রে দেখা যায়। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘দেবদাস’। এই ছবিতে তিনি দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তার বিপরীতে ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী।
১৯৮০ সালে মুক্তি পেয়েছিলো ‘হীরক রাজার দেশে’ গুপী বাঘা সিরিজের এই গল্পে তাকে বিশেষ ভূমিকায় দেখা গিয়েছিলে। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটি ১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও মঞ্চ ছিল তার প্রাণের জায়গা। তিনি মঞ্চেই দম নিতেন। মঞ্চে অভিনয় ও পরিচালনা করেছেন তিনি। মঞ্চে তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম- নাম জীবন, রাজকুমার, ফেরা, নীলকণ্ঠ, ঘটক বিদায়, ন্যায় মূর্তি, টিকটিকি, রাজা লিয়ার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেনাপাওনা ও স্ত্রীর পত্র পরিচালনা করেছিলেন তিনি। থিয়েটারকে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
অভিনয় ছাড়াও লেখালেখি করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কবিতা লেখা ছাড়াও আবৃত্তিও করতেন এই বরেণ্য অভিনেতা। এক্ষণ নামের সাহিত্য পত্রিকারও সম্পাদনা করেছেন।
তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৯১ সালে। অন্তর্ধান ছবির জন্য পেয়েছিলেন বিশেষ জুরি সম্মান। নয় বছর পরে একই সম্মান পান ‘দেখা’র জন্য। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সম্মানিত হতে সময় লেগে যায় আরও ১৫ বছর। অভিনয়জীবনের ৫ দশক পেরিয়ে ২০০৬ সালে ‘পদক্ষেপ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সম্মানিত হন সৌমিত্র। ২০১২-এ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ২০০৪ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারের পালক তার মুকুটে যোগ হয় ২০১২ সালে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর ৮৫ বছর বয়সেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পী।
আরও পড়ুন:
তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন অতি উচ্চ মানের: গৌতম ঘোষ
বড় ক্ষতি হয়ে গেল এই নক্ষত্রপতনে: অপর্ণা সেন
তিনি ছিলেন বাংলা ছবির অভিভাবক: ববিতা
ফেলুদা কিংবা অপু, দেবদাস হয়েই বেঁচে থাকবেন সৌমিত্র
Comments