কেমন হবে বাইডেনের চীন-নীতি?

ক্ষমতা হস্তান্তরে চলমান জটিলতায় প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত জো বাইডেনের কাছে এই মুহূর্তে হয়তো তার প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি সবচেয়ে কম গুরুত্বের তালিকায়। তবুও বিভিন্ন দেশের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে যে বিষয়টি প্রতিদিনই শিরোনাম হচ্ছে গণমাধ্যমে।
Joe Biden
জো বাইডেন। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ক্ষমতা হস্তান্তরে চলমান জটিলতায় প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত জো বাইডেনের কাছে এই মুহূর্তে হয়তো তার প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি সবচেয়ে কম গুরুত্বের তালিকায়। তবুও বিভিন্ন দেশের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে যে বিষয়টি প্রতিদিনই শিরোনাম হচ্ছে গণমাধ্যমে।

গত সোমবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বাইডেনের সম্ভাব্য চীন-নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন তা বাইডেন প্রশাসন কতোটুকু বদলাতে পারবে সে বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে নির্বাচনের আগে বাইডেন শিবির থেকে পরিবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তা কিছুটা হলেও রক্ষা করা হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এতে আরও বলা হয়েছে, গত চার বছর ধরে দুই শীর্ষ অর্থনৈতিক পরাশক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে অবরোধ চাপিয়ে আসছে। এটি এক পর্যায়ে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ হিসেবে বিশ্ব গণমাধ্যমে আখ্যা পায়।

দেশ দুটির তিক্ততা শুধু যে বাণিজ্য কেন্দ্রিক তা নয়। দক্ষিণ চীন সাগরে প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রয়োজনে সামরিক সংঘাতের পথে হাঁটার হুমকিও দেওয়া হয় বেইজিং-ওয়াশিংটন থেকে।

বিশ্লেষকদের মতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে এখনও এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে যে বাইডেন তার পূর্বসূরী ট্রাম্পের দেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগুলোই নিবেন কি না।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি এখনো বুঝতে পারছে না ওয়াশিংটনে নতুন প্রশাসন কোন পথে হাঁটবে।

গত রোববার চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ‘বাইডেনের বিজয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সহজ হবে, না কি আরও জটিল হবে তা নিয়ে চীন কোনো বিভ্রান্তির মধ্যে থাকতে চায় না।’

বাইডেনের টিম এখনো চীন-নীতি নিয়ে কোনো আনু্ষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। তাই বিশ্লেষকরা বাইডেনের অতীতের বক্তব্য থেকে তার পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে এর ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্কের একাল-সেকাল

বারাক ওবামার শাসনামলে তথা ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জো বাইডেন ছিলেন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট। সে সময় দেশ দুটির সম্পর্ক ছিল এক নতুন উচ্চতায়। আংশিকভাবে হলেও সেই সম্পর্ক আজ চীনকে দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছে।

চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হওয়ার পরও সে সময় দেশ দুটি একে অপরের সঙ্গে সংঘাতের পরিবর্তে সহযোগিতার পথই বেছে নিয়েছিল। তাদের মূল বিতর্কগুলো ছিল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও তার স্ত্রী পেং লিউয়ানকে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার স্ত্রী আন্তরিকতার সঙ্গে ওয়াশিংটন ডিসির অ্যান্ড্রুজ বিমান ঘাঁটিতে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

ওবামার মতে, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক একবিংশ শতাব্দীকে বদলে দিবে। তার এই মন্তব্যের পর দেশ দুটির মধ্যে স্থিতিশীল সম্পর্ক শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে নয় সারা বিশ্বের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

বাইডেনও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বেইজিং গিয়েছিলেন। তিনি ওবামার মূলনীতিগুলোতে চীনের সমর্থন চেয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল উত্তর কোরিয়ার পরমাণুশক্তিধর হওয়ার আকাঙ্খাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

২০১৩ সালে এমনই এক সফরে শি জিনপিং তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ‘চীনের পুরোনো বন্ধু’ হিসেবে অভিহীত করেছিলেন। তাদের নির্ধারিত ৪৫ মিনিটের ব্যক্তিগত বৈঠক চলেছিল প্রায় দুই ঘণ্টা।

বাইডেন জনসম্মুখে বলেছিলেন, ‘আমরা যদি একে সম্পর্কের প্রকৃত নতুন মডেল হিসেবে নিতে পারি তাহলে বলব, সম্ভবনা অসীম।’

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই মধুর সম্পর্কের সমালোচনা করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে তার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে তিনি চীনকে সম্ভাব্য অংশীদার থেকে আসল শক্রতে পরিণত করেন।

বাইডেনও গত ফেব্রুয়ারিতে তার ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়ন পাওয়ার লড়াই চলাকালে শি জিনপিংকে ‘ঠগ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বেইজিংকে ‘আইন মেনে চলার’ পরামর্শও দিয়েছিলেন তখন। গত জুনে বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণা শিবির থেকে ট্রাম্পকে চীনের ‘পুতুল’ বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।

২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ডেমোক্রেটিক দলের ‘ইশতেহারে’ চীন সম্পর্কে ছিল সাতটি বাক্য। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ এ।

নির্বাচনী প্রচারণায় চীনের অর্থনীতি, সামরিক শক্তি ও মানবাধিকার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ডেমোক্রেটরা।

বাণিজ্য

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম দিক হলো চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ। ২০১৮ সাল থেকে তার প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে চলেছে। উদ্দেশ্য— চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমোনো ও চীনের অর্থনৈতিক বিকাশ রোধ।

চীনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে আলোচনা গত জানুয়ারিতে শুরু হলেও এখনো অনেক বিষয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধ রয়ে গেছে।

বাইডেনের সাম্প্রতিক মন্তব্যে বোঝা যায় তিনি চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কঠিন অবস্থান নীতি চালিয়ে যাবেন। তবে গত আগস্টে গণমাধ্যম এনপিআর’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন বলেছিলেন, তিনি মনে করেন শুল্ক আরোপ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্যেই ক্ষতিকর। আরও বলেন, ‘চীনের ক্ষেত্রে আমরা ভুল পথে এগোচ্ছি।’

ধারণা করা হচ্ছে, চীনের অর্থনীতি উদার করার জন্যে বাইডেন প্রশাসন অন্যান্য দেশকে সঙ্গে নিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ডেমোক্রেটিক প্লাটফর্ম মনে করে, বাইডেন প্রশাসন ফাইভজি নেটওয়ার্কের ব্যবহার নিয়ে চীনের শীর্ষ প্রযুক্তি সংস্থা হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। তারা বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে নিরাপদ সাইবারস্পেস গড়ে তুলতে আগ্রহী।

দক্ষিণ চীন সাগর

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন সরকারের দাবির বিরুদ্ধে ওবামা ও ট্রাম্প প্রশাসন একই নীতি অনুসরণ করছে।

ওবামা-বাইডেনের শাসনামলে সাগরে বিশাল কৃত্রিম দ্বীপ তৈরির কাজ শুরু করেছিল চীন। তখন সেই দ্বীপের কাছে নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্প প্রশাসন দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের অধিকারের দাবিকে ‘অবৈধ’ বলে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে।

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বাইডেন জনসম্মুখে তেমন কোনো মত প্রকাশ না করলেও তিনি যে ট্রাম্পের নীতিই গ্রহণ করবেন না এমন কোনো লক্ষণ নেই। বরং তিনি এ বিষয়ে ট্রাম্পের চেয়েও কঠোর নীতি গ্রহণ করতে পারেন বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

২০১৬ সালে ডেমোক্রেটিক প্লাটফর্ম ‘দক্ষিণ চীন সাগরের ‘স্বাধীনতা’ রক্ষার কথা বলেছিল। চার বছর পর তারা সেই অঞ্চলে চীনের সামরিক বাহিনীর ‘মহড়া’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এমনকি, নির্বাচনী প্রচারণায় বাইডেন কয়েকবার বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট শি ২০১৩ সালে আমাকে বলেছিলেন সেই অঞ্চলের ওপর দিয়ে আমাদের উড়োজাহাজ চলাচল করতে পারবে। তখন যেমনটি চলছিল।’

প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর বাইডেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বিস্তার রোধ নিয়ে কথা বলেছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী সুগা ইয়োশিহিদির সঙ্গে। সিএনএন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাইডেন পূর্ব চীন সাগরে সেনকাকু দ্বীপ রক্ষার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিজ্ঞার কথা জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। এই দ্বীপের মালিকানা চীন ও জাপান উভয়েই দাবি করে আসছে।

তাইওয়ান, জিনজিয়াং, হংকং

ক্ষমতায় থাকার শেষ বছরে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেন। তার প্রশাসন স্বশাসিত দ্বীপটিতে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমতি দেয়।

গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসচিব অ্যালেক্স আজার তাইওয়ান সফর করেন। গত কয়েক দশকে তিনিই প্রথম মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তা যিনি তাইওয়ান সফরে করলেন।

বাইডেন বহু বছরে থেকেই তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। ১৯৭৯ সালে সিনেটর থাকা অবস্থায় তিনি তাইওয়ানের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।

গত জানুয়ারিতে সাই ইং-ওয়েন আবারো তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বাইডেন তাকে টুইট করে শুভেচ্ছো জানিয়েছিলেন।

নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় তাইওয়ান নিয়ে বাইডেন কিছু না বললেও তিনি যে ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করবেন না এর কোনো ইঙ্গিত নেই।

২০১৭ সালে ট্রাম্পের ক্ষমতা নেওয়ার সময় থেকেই জিনজিয়াং প্রদেশে জাতিগত উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীন সরকারের নির্যাতনের সংবাদ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব মতে, ২০ লাখের মতো উইঘুরিকে বন্দি শিবিরে রাখা হয়েছে। সেখানে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে।

গত এক বছরে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের জিনজিয়াং নীতির বিরোধিতা করে দেশটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তাদের ওপর অবরোধ ও উইঘুরিদের দিয়ে জোর করে উৎপাদিত পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তিনি।

গত ফেব্রুয়ারিতে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারি বিতর্কে বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘সেই মানুষটি একজন ঠগ। তিনি ১০ লাখ উইঘুরিকে “পুনর্গঠন শিবিরের” নামে বন্দি শিবিরে আটকে রেখেছেন।’

বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণায় জিনজিয়াংয়ে চীনের ‘গণহত্যা’ চালানোর বিষয়টিও উঠে এসেছিল।

তবে অনেক উইঘুরি মনে করেন, হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্প চলে গেলে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর মনোভাব নরম হয়ে যেতে পারে।

একইভাবে হংকংয়ে চীনের একদলীয় শাসনবিরোধী গণতন্ত্রপন্থিদের অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় আসুক।

তাদের আশঙ্কা বাইডেন প্রশাসন বেইজিংয়ের প্রতি কঠোর অবস্থান নিতে নাও চাইতে পারে।

তবে গত মে মাসে বাইডেনের প্রচারণা শিবির থেকে এক বার্তায় বলা হয়েছিল, হংকংয়ে চীনের কঠোর অবস্থানের জন্যে ট্রাম্পই দায়ী।

তবে ক্ষমতায় বসার পর বাইডেন প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিবে তাই এখন দেখার বিষয়।

আরও পড়ুন:

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বাইডেনের পরিকল্পনা

Comments