যে ভূমি তোমার খাস, সে ভূমিতে আমার বাস

উন্নয়নের নামে, পর্যটনের নামে ক্রমাগতভাবে পাহাড়িদের ভূমি দখলের অভিযোগ শুধু বাড়ছেই। ঐতিহাসিকভাবে যেসব জুম ভূমির মালিক জুমিয়ারা, তাদের অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে।
পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ ও পর্যটনের নামে প্রাচীন জুম ভূমি কেড়ে না নেওয়ার দাবি জানিয়েছে পাহাড়িরা। ছবি: সংগৃহীত

উন্নয়নের নামে, পর্যটনের নামে ক্রমাগতভাবে পাহাড়িদের ভূমি দখলের অভিযোগ শুধু বাড়ছেই। ঐতিহাসিকভাবে যেসব জুম ভূমির মালিক জুমিয়ারা, তাদের অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে।

পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে জুম্মদের ভূমির অধিকার, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হলেও চুক্তির সে সুফল আজও পাননি জুম্মরা।

সম্প্রতি বান্দরবানের নাইতং পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল ও পর্যটন স্পট নির্মাণের জন্য একটি কল্যাণ সংস্থা এবং সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রায় এক হাজার একর ম্রোদের জুম ভূমি দখলের পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে।

গত ৭ অক্টোবর ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো গ্রামবাসীরা বান্দরবানের জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দেন।

স্মারকলিপি দেওয়ার ঠিক এক মাস পর ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো জনগোষ্ঠী নাইতং পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ ও পর্যটনের নামে তাদের প্রাচীন জুম ভূমি কেড়ে না নেওয়ার দাবি জানিয়ে চিম্বুক পাহাড়ে হৃদয় বিদারক বাঁশির সুরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

জুম্মদের স্বায়ত্তশাসন এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য শাসক সম্প্রদায় সবসময় উদাসীন ছিলেন বলেই প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা এই ভূমিজ সন্তানদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন জুম ভূমি হারানোর আশঙ্কায় প্লুং (বাঁশি) বাজিয়ে আর্তনাদের সুর তুলতে হয়েছে।

একটি মানবিক রাষ্ট্রের জন্য ম্রোদের সেদিনের সেই করুণ সুর সত্যিই খুব বেদনাদায়ক।

‘আমাদের জুম ভূমি কেড়ে নেবেন না’- প্রকৃতির সন্তানদের এমন গগন বিদারী চিৎকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা এই ভূমিজ সন্তানদের ওপর আমাদের ক্রমাগত অমানবিক, স্বেচ্ছাচারী এবং দানবিক সিদ্ধান্ত একদিন দীর্ঘশ্বাসের অভিশপ্ত উত্তর নিশ্চিত করবে।

শান্তি চুক্তি সই হওয়ায় জুম্ম জনগণের মধ্যে আশা জেগেছিল যে তারা শান্তি, মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে পাহাড়ে টিকে থাকতে পারবেন।

কিন্তু রাষ্ট্র পাহাড়িদের সেই শান্তি, অধিকার কিংবা মর্যাদা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। পারেনি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ধারা বাস্তবায়ন করতে।

১৯৯৭ সালে এই চুক্তি সই হওয়ার পর থেকে শুধু বান্দরবানের আটটি মৌজায় প্রায় ২৩০টি জুমিয়া পরিবারকে তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পর্যটন, রাবার বাগান এবং সামাজিক বনায়নের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের হাজার হাজার একর জুম ভূমি দখল হয়েছে।

প্রভাবশালী ভুমিদস্যুরা পুলিশ, প্রশাসন এবং জেলার শীর্ষ জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিনিয়ত পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমিয়াদের ভূমি কেড়ে নিচ্ছেন, তাদের উচ্ছেদ করছেন।

২০১৫ সালে একটি রাবার প্ল্যান্টেশনের বিরুদ্ধে বান্দরবানের লামায় প্রায় একশ ম্রো এবং মারমা পরিবারের জুম ভূমি দখলের অভিযোগ উঠেছিল।

দ্য ডেইলি স্টারে এ নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

সে সময় বান্দরবানের একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বান্দরবান ছেড়ে অন্য জায়গায় বদলি হওয়ার কিছু দিন আগে আনঅফিসিয়ালি একটি তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বান্দরবানের ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ একজন জনপ্রতিনিধি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন ঐ রাবার কোম্পানিকে সহযোগিতা করা হয়।

২০১৬ সালের অক্টোবরে খাগড়াছড়ির আলুটিলায় প্রায় ৩০০ ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমা পরিবারের জুমের জায়গায় একটি বিশেষ ট্যুরিজম জোন করার জন্য জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রায় ৬৯৯ দশমিক ৯৮ একর জায়গা অধিগ্রহণের প্রস্তাব করে সরকার।

সেসময় ক্ষতিগ্রস্ত জুমিয়ারা পর্যটনের নামে তাদের জুম ভূমি হারানোর প্রতিবাদ করতে চাইলে শাসকগোষ্ঠী প্রতিবাদকারীদের ভয় দেখায় এবং বাঁধা দেয়।

পরবর্তীতে দ্য ডেইলি স্টারে এই নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সরকার আলুটিলায় প্রস্তাবিত বিশেষ ট্যুরিজম জোন প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সরকারের এই মানবিক সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই।

অধিকার বঞ্চিত, পিছিয়ে থাকা ম্রো জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার যারা কেড়ে নিতে চায়, তারা কী তাহলে সরকারের চাইতেও অনেক শক্তিশালী?

যদি সরকারের চাইতে ম্রোদের ভূমি দখলকারীরা শক্তিশালী না হয় তাহলে খুব দ্রুতই সরকার ম্রোদের আশ্বস্ত করবেন যে নাইতং পাহাড়ে পর্যটনের নামে তাদের ভূমির অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, কোনও জুমিয়া পরিবারকে উচ্ছেদ হতে হবে না।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরে বান্দরবানের লামা উপজেলার মংবিচর বাচিং মারমাপাড়া, চারিজ্ঞ্যা ত্রিপুরা কারবারিপাড়া, আমতলি ম্রোপাড়া, লুলাইনমুখ ম্রোপাড়া এবং সুনাং ম্রোপাড়া; নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার রাঙ্গাঝিরি চাকমাপাড়া, ডলুঝিরি মারমাপাড়া, বাদুরঝিরি চাকপাড়া, লং-গদু চাকপাড়া, হামরাঝিরি মারমাপাড়া, সাপমারাঝিরি পাড়া এবং শুই জাইং চাকপাড়া; আলীকদমের উকলিংপাড়া, মেনসম ম্রোপাড়া এবং সদর উপজেলার সাইংগা মারমাপাড়া থেকে জুমিয়া পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

ভুমিদস্যুরা প্রশাসনের অসাধু চক্রকে কাজে লাগিয়ে ভুয়া নথি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম ভূমি কিনছে, এখন অনেকটা প্রকাশ্য বিষয় হয়ে গেছে।

যে ভূমিতে জুমিয়া পরিবারগুলো বংশ পরম্পরায় জুম চাষ করে জীবনধারণ করে এসেছে, হঠাৎ করে ভূমি দস্যুরা একটি কাগজ দেখিয়ে তাদের বলছে, তোমাদের দখলে থাকা এই ভূমি খাস, প্রশাসন কিংবা জেলা পরিষদের কাছ থেকে এই ভূমি আমরা লীজ নিয়েছি। আজ থেকে এই ভূমির মালিক আমি।

বেঁচে থাকার লড়াইয়ে যারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছেন, যাদের মৌলিক অধিকারটুকু আমরা এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি, সেই ভূমি পুত্রদের নিজ ভূমি থেকে এভাবেই ক্রমাগত উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা সুবিধা বঞ্চিত জুম্মদের উচ্ছেদের এই ধারাবাহিকতা এই রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থেই অমানবিক করে তুলছে।

ভূমি হারানোর আশঙ্কায় চিম্বুক পাহাড়ে বাঁশির সুরে-সুরে ম্রোদের আর্তনাদ শাসক গোষ্ঠীসহ রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সত্যিকার অর্থে মানবিক করে তুলবে এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

Comments

The Daily Star  | English
Preparing for Ramadan's Price Shocks

Power price to go up 4 times a year

The government has drawn up a plan to increase the price of electricity four times a year for the next three years to withdraw all subsidies in the power sector, which the IMF recommends.

17m ago