খাসিয়া পুঞ্জিতে ‘হামলা আতঙ্ক’ কাটছে না

আবার যেকোনো সময় হামলা হতে পারে, এমন আতঙ্কে দিন কাটছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ইছাছড়া পুঞ্জির ৫২টি খাসিয়া পরিবারের।
Moulvibazar.jpg
খাসিয়া পুঞ্জিতে হামলার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা। ছবি: স্টার

আবার যেকোনো সময় হামলা হতে পারে, এমন আতঙ্কে দিন কাটছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ইছাছড়া পুঞ্জির ৫২টি খাসিয়া পরিবারের।

গত ৯ নভেম্বর এক খাসিয়া পরিবারের জোরপূর্বক দখল হয়ে যাওয়া জমি ৪৩ দিন পর প্রশাসনের প্রচেষ্টায় উদ্ধার করে পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওইদিন রাতে পুঞ্জিতে হামলার ঘটনা ঘটে।

সেদিন দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত প্রশাসন, র‌্যাব ও পুলিশের যৌথ উদ্যোগে অবৈধ দখল উচ্ছেদে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এটিএম ফরহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অভিযানকালে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তানভীর হোসেন, র‌্যাব-৯ শ্রীমঙ্গলের উপ-সহকারী পরিচালক মো. মিজানুর রহমান, কুলাউড়া থানার এসআই আব্দুর রহিম জিবানসহ র‌্যাব ও পুলিশের প্রায় ত্রিশ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের কাটাবাড়িতে দখলকৃত পান জুমে পাহারা দেওয়ার দুটি ছাউনি ও একটি আধপাকা টিন শেডের ঘর উচ্ছেদ করা হয়। তবে অভিযুক্ত দখলদার রফিক আলীকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি।

সেসময় দখলকৃত স্থানের একটি ঘরে থাকা দুজন নারী শ্রমিককে আটক করে প্রশাসন। তাদের একজন কুলাউড়ার গাজীপুরের বাসিন্দা মৃত আইয়ুব আলীর স্ত্রী লতিফা বেগম (৪১) এবং অন্যজন কর্মধার টাট্টিউলি এলাকার বাসিন্দা মৃত তছির আলীর স্ত্রী রোমেনা বেগম (৩৮)।

তারা জানান, দেড় মাস আগে স্থানীয় প্রভাবশালী রফিক তাদের মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার কথা বলে এখানে এনে শ্রমিকের কাজ করাচ্ছেন।

পরে ইউএনও কার্যালয়ে লিখিত মুচলেকা নিয়ে ওই দুই নারীকে স্থানীয় ইউপি সদস্য সিলভেস্টার পাঠাংয়ের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

পান জুমের মালিক জসপার আমলরং বলেন, ‘আমার বৈধ কাগজপত্র আছে। এজন্য অভিযানের পর জমি আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ভুয়া দলিল দেখিয়ে গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতের আধারে স্থানীয় টাট্টিউলি গ্রামের প্রভাবশালী প্রবাসী রফিক জোরপূর্বক প্রায় পাঁচ একরের পানের জুমটি দখল করে নেয়।’

‘গত দেড় মাসে সে এই জুম থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার পান বিক্রি করে আমার আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছে। একমাত্র আয়ের উৎস পান জুমের টাকা দিয়েই গত তিন বছর ধরে নিজের ক্যান্সারের চিকিৎসাসহ পরিবার চালিয়ে আসছি। প্রশাসনের প্রচেষ্টায় পানের জুমটি ফিরে পেলেও এখনো আমার হামলা আতঙ্ক কাটছে না।’

কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং বলেন, ‘প্রশাসনের অভিযানের পরও রফিক মিয়া ৫০-৬০ জনের একটি দল নিয়ে পান জুমের আশপাশে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি যেকোনো সময় আবারও পান জুমের ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করতে পারেন। তার এতো সাহস যে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে দখলকৃত জমি উদ্ধারের পরও সে হামলা করল। এখন আমরা সবাই আতঙ্কে আছি।’

কয়েক বছর টানা যত্নের ফলে জুমে পান আসা শুরু হয়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই রফিক মিয়া ও তার গংরা জোরপূর্বক পান জুমটি দখল করে নেয় বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে জানতে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত রফিক মিয়ার সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কুলাউড়ার ইউএনও এটিএম ফরহাদ চৌধুরী জানান, আমরা দখলকারী রফিক মিয়ার দলিলের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকা সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে পাঠাই। পরে সদর রেকর্ড রুমের সাব-রেজিস্ট্রার মো. জাহিদ হোসেন স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে জানানো হয়, ১৯৬৭ সালের ১১৪৪০ নম্বর এবং ১৯৮২ সালের ৬৭৮২ নম্বর দলিলগুলির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। এরপর জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের নির্দেশনা অনুসারে আমরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি এবং পান জুমের প্রকৃত মালিককে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জমি উদ্ধার করে যাওয়ার পর ওইদিন সন্ধ্যায় পুঞ্জির ক্যাথলিক গির্জায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। সেসময় একজন আহত হন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য ফাদার জোসেফ গোমেজ ওএমআই বলেন, ‘খাসিয়াসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, ভূমির অধিকার ও মানবাধিকার সবকিছু দেখার দায়িত্ব সরকারের। ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি তারা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে। হঠাৎ করে প্রভাব দেখিয়ে একটি চক্র তা দখল করে ফেলল, এটি কেমন কথা!’  

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘জেলা ও উপজেলা প্রশাসন যে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালন করল, সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। প্রশাসন উদ্ধার করে দিল, এটি আইনগত পদক্ষেপ, এটি খুবই প্রশংসনীয়। তরে ভূমিলোভীরা যে সংখ্যালগুদের গ্রামে আক্রমণ করল, গীর্জা ভাঙচুর করল, এটি তো তারা করতে পারে না। এ বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যেন এমন হামলা আর না হয়। এজন্য প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সজাগ থাকতে হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago