‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’

বুধবার তার জীবন প্রদীপ যখন নিভে যাওয়ার খবর চাউর হলো। তাবৎ দুনিয়া যেন একটা ছোট্ট গ্রাম হয়ে গেল। শত শত কোটি মানুষ ভাসল একই আবেগে! আর কারো জন্য কখনো এমন হয়েছে কি!
ম্যারাডোনার জন্য ফুটবল ভক্তের কান্না। ছবি: রয়টার্স

‘আই অ্যাম ব্ল্যাক অর হোয়াইট, আই উইল নেভার বি গ্রে ইন মাই লাইফ’- মোহনীয় ফুটবল শৈলী, খ্যাপাটে চরিত্র, পরোয়া না করা মানসিকতা, মাদক, একের পর এক বিতর্ক, এসবের মধ্যেই আবার জীবনকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার উন্মাদনা। নাহ! দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা ৬০ বছরের জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও ধূসর হননি। প্রস্থানে যেন হয়ে উঠলেন আরও বর্ণিল।

বুধবার তার জীবন প্রদীপ যখন নিভে যাওয়ার খবর চাউর হলো। তাবৎ দুনিয়া যেন একটা ছোট্ট গ্রাম হয়ে গেল। শত শত কোটি মানুষ ভাসল একই আবেগে! আর কারো জন্য কখনো এমন হয়েছে কি!

শৈশবে দারিদ্র্য, ফুটবল প্রেম। কৈশোরে নাম কুড়ানো, তারুণ্যে দুনিয়া মাত। বাকি জীবনটাও তার তারুণ্যই। ম্যারাডোনা চেনা পথে হেঁটে একটাই জীবন পার করেননি। জীবনকে নিয়ে খেলেছেন বিস্তর। এক জীবনে পেয়েছেন বহু জীবনের স্বাদ।

ম্যারাডোনার জীবনরেখা

১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর শ্রমিকের ঘরে জন্ম তার। শৈশবের লড়াই ছিল খাওয়া পরা নিয়েই। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল পাগল দেশগুলোতে যা হয়। প্রেম হয়ে যায় ফুটবলের সঙ্গে। সেই প্রেমই পরে ঠিক করে দিল ম্যারাডোনার গতিপথ। মাত্র ১৬ বছর বয়েসেই পা পড়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে। ১৭ বছর বয়েসে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ ছিল। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে পাননি জায়গা। ১৯৮২ বিশ্বকাপেই আলো ছড়ানো শুরু। পায়ের মুন্সিয়ানা দেখানো শুরু ফুটবল জগতকে। তবে ব্রাজিলের বিপক্ষে সেবার লাল কার্ডে হয়েছিল তার সমাপ্তি।

১৯৮৬ বিশ্বকাপ কে না জানে তা কেবলই ম্যারাডোনার। গড়পড়তা আর্জেন্টিনা দলকে একাই চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচে দুই গোল আজও ফুটবল রসিকদের আড্ডায় মূল আলোচনার বিষয় বস্তু। রেফারির চোখ ফাঁকি দিয়ে হাত দিয়ে করেছিলেন গোল। যাকে তিনি পরে তকমা দেন ‘হ্যান্ড অব গড’ হিসেবে। এমন অবৈধ কাজ বড় একটা অংশেরই পছন্দ হওয়ার কথা নয়। বিরুদ্ধে গেছে স্পোর্টস স্পিরিটেরও। কিন্তু ম্যারাডোনা এসব তোয়াক্কা করার লোক নাকি! পরের গোলটি অবশ্য যে কাউকে হতবাক করে দিবে। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে কয়েকজনকে কাটিয়ে করা তার গোল অনেকের মতেই শতাব্দী সেরা। এমন ড্রিবলিং মুন্সিয়ানা যে কাউকে তার ভক্ত বানিয়ে দিতে বাধ্য।

১৯৯০ বিশ্বকাপেও তার জাদুতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে ছিল আর্জেন্টিনা। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির পক্ষে রেফারির বিতর্কিত এক পেনাল্টি কান্নায় ভাসায় ম্যারাডোনা ও তার শত কোটি ভক্তদের। সেই ম্যাচ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত কিনা তা নিয়ে আছে আলোচনা। 

আরও পড়ুন- বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু দিনেই বিদায় নিলেন ‘ফুটবলের চে’

নাপোলি

ম্যারাডোনা যতটা আর্জেন্টিনার ততটাই ইতালির নেপলস শহরের। এই শহরের ক্লাব নেপোলির হয়ে তার বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়। নাপোলির গল্প ছাড়া ম্যারাডোনা অসম্পূর্ণ। ইতালির দক্ষিণাঞ্চলের অবহেলিত জনপদ নেপলস। এই শহরের ক্লাবের বড় কোন অর্জনের সম্ভাবনাই ছিল আকাশচুম্বি ভাবনা। ম্যারাডোনা সেই নাপোলিকে দুটি সিরি আ জিতেছেন, ইউরোপা কাপসহ এনে দিয়েছেন পাঁচ ট্রফি। সেই সাফল্য আজও ক্লাবটি ছাপিয়ে যেতে পারেনি। নেপলসের রাস্তায় রাস্তায় ম্যারাডোনার মূর্তি, দেয়ালে দেয়ালে তার গ্রাফিথি। বিশ্বকাপের মঞ্চে তার ঝলক দুনিয়া দেখলেও নাপোলির হয়ে অর্জনের অনেক ফুটেজই মেলে না। কিন্তু সেখানকার বাসিন্দারের মনের ছবিতে তিনি উজ্জ্বল থেকে গেছেন যুগের পর যুগ। বুধবার তার প্রয়াণে কান্নার মিছিল দেখা গেছে নেপলসে। বুইয়েন্স আইরেস থেকেও ম্যারাডোনাকে যেন বেশি আপন করে ভালোবেসেছিল তারা।

মাদকের ছোবল

নব্বুই বিশ্বকাপের পর থেকেই ম্যারাডোনা নতুন প্রেমে মগ্ন। মাদকের সেই প্রেম তাকে নিয়ে গেছে ধ্বংসের দিকে। অবশ্য এই প্রেমিকার সঙ্গে তার পরিচয় ১৯৮৩ সালে। বার্সেলোনায় খেলার সময় কোকেনে আসক্ত হয়েছিলেন। নব্বুইর পর কোকেন নেওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। ১৯৯১ সালে নাপোলিতে খেলার সময় ১৫ মাস এইজন্য নিষিদ্ধ হন তিনি। ফুটবলের জাদুর সঙ্গে মাদকের ছোবল- এমন দোলাচল নিয়ে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে খেলতে গিয়েছিলেন তিনি। প্রথম ম্যাচে করেন দারুণ গোল। পরের ম্যাচেও দেখান মুন্সিয়ানা। এরপরই ডোপ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে আসে আবার নিষেধাজ্ঞার খবর। তবে ইতালিয়ান মাফিয়াদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে কীনা, এই নিয়ে আছে বিতর্ক। ম্যারাডোনার নিষিদ্ধ সংবাদ মানতে না পেরে এমনকি মিছিল হয় বাংলাদেশেও।

ম্যারাডোনার আন্তর্জাতিক ফুটবল আর এগোয়নি। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রিয় ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের হয়ে মাঠে পাওয়া যায় তাকে। বোকা জুনিয়র্স, আর্জেন্টিনা, বার্সেলোনা, নাপোলি- দুনিয়া জুড়ে ভালোবাসার অনেক ঘর রেখে বুট জোড়া তোলে রাখেন তিনি। পেছনে পড়ে থাকে অনেক অর্জন।

খেলা ছাড়লেও ম্যারাডোনা খবরের আড়াল হননি একবারও। চুটিয়ে প্রেম করে খবর হয়েছেন, কখনো ভরা সংবাদ সম্মেলনে গুলি ছুঁড়ে হয়েছেন নিন্দিত। আবার একেবারে আউট অব দ্য বক্স কিছু বলে এসেছেন আলোচনায়।

রাজনীতি

ফুটবল খেলার সময়েই তার সঙ্গে সখ্যতা ফিদেল কাস্ত্রোর। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বিরোধিতা করে কিউবার নেতৃত্ব দিয়ে চলা এই নেতার সঙ্গে জড়িয়ে যান ম্যারাডোনা। তার মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির পুনর্বাসন চলে কিউবাতেও। ফিদেলের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেন তিনি। বিপ্লবী আর্নেস্টো চে গেভেরার উল্কি বাহুতে আর ফিদেলের উল্কি খোদাই করে নেন মোহাবিষ্ট করা বা পায়ে। সমাজতন্ত্রের স্পষ্ট সমর্থক হয়ে সাম্রাজ্যবাদের কট্টোর সমালোচনা করতে দেখা যায় তাকে। হয়ে উঠেন নিপীড়িত মানুষের ভাষ্যকার।  দুনিয়া কাঁপানো কোন ক্রীড়া সেলিব্রেটির মার্কিন বিরোধিতার এমন নজির একটাও নেই। ফুটবল ঈশ্বরের সঙ্গে তাই তিনি হয়ে যান ‘ফুটবলের চে’।

এবং

২০১০ সালে কোচের ভূমিকায় বিশ্বকাপ জেতার মিশন নিয়েছিলেন। লিওনেল মেসিদের নিয়ে সেই অভিযান ব্যর্থ হয় ম্যারাডোনার। পরে কোচিং ক্যারিয়ারে অন্য কোথাও সাফল্য ধরা দেয়নি তার। কিন্তু তাতে কি? ফুটবলার ম্যারাডোনা আদি ও অকৃত্রিম থেকে গেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কেবল ম্যারাডোনাকে দেখেই ফুটবল ভালোবাসতে শিখেছে অসংখ্য মানুষ।

আশি-নব্বুই দশকের একটা বড় প্রজন্মের শৈশবের মূল নায়ক ছিলেন তিনি। বিপুল মানুষের রঙ করা শৈশব নিয়েই যেন বিদায় নিলেন ফুটবলের জাদুকর। কবি জীবনানন্দ দাশের লাইনটি তাই তার বেলায় ভীষণ জুতসই।

 

Comments

The Daily Star  | English

Ex-public administration minister Farhad arrested

Former Public Administration minister Farhad Hossain was arrested from Dhaka's Eskaton area

3h ago