ভারতে ১০০ কোটি মানুষকে কীভাবে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হবে?
করোনা ভ্যকাসিন ট্রায়ালে ক্রমবর্ধমান সাফল্য দেখে অনেকেই আশা করছেন হয়তো চলতি বছরেই এর অনুমোদন পাওয়া যাবে। অনেকে ভাবছেন, চলতি বছরে না হলেও নতুন বছরের প্রথম দিকেই মিলবে জীবন রক্ষাকারী বহুল প্রত্যাশিত এই ওষুধ।
তবে, ভ্যাকসিন অনুমোদনের পর কীভাবে তা সরবরাহ করা হবে, কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, কারা অগ্রাধিকার পাবেন— এসব নিয়ে দেশে দেশে চলছে ব্যাপক আলোচনা।
আজ বৃহস্পতিবার বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন রাখা হয়েছে— পৃথিবীর দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারতে ১০০ কোটি মানুষকে কীভাবে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হবে?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সম্মিলিত টিকাদান কর্মসূচির ৬০ শতাংশই কভার করে ভারত। এছাড়াও, বিশ্বের এক ডজন বৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ছয়টিই রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে। সেগুলোর মধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া অন্যতম।
বিশ্বের ৩০টি ভ্যাকসিন প্রার্থী সংস্থার মধ্যে ভারতে রয়েছে পাঁচটি। তারা দেশটিতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করছে। এগুলোর মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন পরীক্ষা করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। এছাড়াও, ভারত বায়োটেক নিজস্ব ভ্যাকসিন উন্নয়নে কাজ করছে।
তবুও আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভ্যাকসিন সরবরাহ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অব্যবস্থা হলে এ সাফল্য থেকে বঞ্চিত হতে পারেন ভারতের জনগণ।
রয়েল সোসাইটি অব লন্ডনের ফেলো হিসেবে নির্বাচিত প্রথম ভারতীয় নারী ড. গাগেনদিপ কং বিবিসিকে বলেছেন, ‘সবকিছুই চ্যালেঞ্জিং। আমরা এখনো বুঝতেই পারছি না কী ধরনের জটিলতা আমাদের সামনে রয়েছে।’
তার মতে, ভারতের অর্ধেক জনগণকে ভ্যাকসিন দিতে অন্তত কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
সরবরাহ ব্যবস্থা
বিবিসি’র প্রতিবেদন মতে, ভারতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ভ্যাকসিন রাখার ‘কোল্ড চেইন’ স্টোর রয়েছে ৩৭ হাজারের মতো। সেখান থেকে ভ্যাকসিনগুলো ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ভেতরে রেখে দেশটির ৮০ লাখের বেশি স্থানে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু, এটিই কি যথেষ্ট হবে?
পুনর্ব্যবহার ও পুনরায় সংক্রমণ রোধে ভারতের প্রয়োজন যথেষ্ট সংখ্যক স্বয়ক্রিয়ভাবে নষ্ট হয়ে যায় এমন সিরিঞ্জ। এসব সিরিঞ্জের বিশাল চাহিদা মেটাতে দেশটির বৃহৎ সিরিঞ্জ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দিয়েছে আগামী বছরের মধ্যে তারা ১০০ কোটি সিরিঞ্জ উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।
তারপরও প্রশ্ন জাগে— কাঁচের শিশিগুলো কী সুনিপুণভাবে সরবরাহ করা যাবে?
গণহারে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হলে এই বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য কীভাবে নষ্ট করা হবে?
ভারতের টিকাদান কর্মসূচির আওতায় ৪০ লাখ চিকিৎসক ও নার্স রয়েছেন। কিন্তু, করোনা ভ্যাকসিন দিতে গেলে এর চেয়ে বেশি সংখ্যক চিকিৎসক-নার্সের প্রয়োজন।
ভারতের শীর্ষ জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা বায়োকনের প্রতিষ্ঠাতা কিরণ মজুমদার শ বিবিসি’কে বলেছেন, ‘দেশের গ্রামাঞ্চলে কীভাবে এই সেবা পৌঁছে দেওয়া হবে তা ভেবে আমি উদ্বিগ্ন।’
যদিও বা তা পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে প্রথমে কাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে?
ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য বিভাগের ফ্রন্টলাইন কর্মীরা প্রথমে করোনা ভ্যাকসিন পাবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বলা যতটা সহজ, করা ততটা সহজ নয়।
ভারতের শীর্ষ মহামারি বিশেষজ্ঞ ড. চন্দ্রকান্ত লাহিড়িয়া বিবিসি’কে বলেছেন, ‘আমরা কখনোই যথেষ্ট পরিমাণে ভ্যাকসিন পাব না। তাই কাদেরকে প্রথম ভ্যাকসিন দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।’
ভারতে ৭ কোটির বেশি ডায়াবেটিকসের রোগী রয়েছেন। সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর দ্বিতীয়। তাদের সবাইকে কি এই কর্মসূচির আওতায় আনা যাবে?
এক সঙ্গে দেশের ৩০টি রাজ্যের সবগুলোতেই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়া সম্ভব না। তাহলে কি যেসব রাজ্যে করোনা রোগীর সংখ্যা বেশি সেখানে আগে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে?
ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি যে হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
ভ্যাকসিন ডোজ ট্র্যাকিং
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ ব্যবস্থা বিভাগের শিক্ষার্থী ড. প্রশান্ত যাদব বিবিসি’কে বলেছেন, ‘ভারতে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি মূলত পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় ক্লিনিকগুলো। সেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেওয়া হয় না। প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেওয়ার জন্যে বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি নেই। এছাড়াও, সাধারণত প্রাপ্তবয়স্করা কোনো সরকারি ক্লিনিকে যান না।’
আজকের বাস্তবতায় একটি সুসম্মন্বিত সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে করোনা ভ্যাকসিন কর্মসূচিতে সাফল্য আনা যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই।
প্রতারণা?
বিবিসি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভ্যাকসিন পেতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হবে কি না তা নিয়েও আশঙ্কা করেছেন অনেকে।
অনেকের প্রশ্ন— প্রথম দফাতেই ভ্যাকসিন পেতে প্রভাবশালীরা দুর্নীতির আশ্রয় নিবেন নাতো? এছাড়াও, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাজারগুলোতে নকল ভ্যাকসিনের আর্বিভাব ঠেকানো হবে কিভাবে?
Comments