প্রবাসে

লিঙ্গ-সমতা নিশ্চিতে জাতীয় কৌশল জার্মানির

ছবি: সংগৃহীত

নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লিঙ্গ-সমতা বাড়াতে জাতীয় কৌশল গ্রহণ করেছে জার্মানি। বিষয়টি হয়তো অবাক করবে অনেককেই। কারণ জার্মানির মতো এমন উন্নত একটি দেশে লিঙ্গ-বৈষম্য আছে, এটা বিশ্বাস করতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই সত্যি! নারীর সমানাধিকার এবং মানুষ হিসেবে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রক্রিয়াটি জার্মান সমাজে অনেকটা ধীরগতিতে এগিয়েছে। এই ধীর প্রক্রিয়াটিতে গতি আনতে নতুন কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করেছে জার্মান।

জার্মান ফেডারেল সরকারের পরিবার বিষয়ক মন্ত্রী ফ্রান্সিসকা গিফে এ বছরের ৮ জুলাই নতুন এই জাতীয় কৌশল উপস্থাপন করেছেন। নতুন কৌশলের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট। সরকারি সব দপ্তরসহ বেতন কাঠামো লিঙ্গ-বৈষম্য দূর করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এতে। পাশাপাশি ব্যবসা এবং  রাজনীতিতে নারীদের আরও বেশি এবং অর্থবহ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের বিষয়টিতেও বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কৌশলটিকে 'মাইলফলক' হিসেবে উল্লেখ করে ফ্রান্সিসকা গিফে বলেছেন, ‘ফেডারেল জার্মান প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে এটিই প্রথম সমতা কৌশল যা সবগুলো দপ্তরের সমন্বিত এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।’

কৌশলটিতে কর্মজীবনের ভারসাম্য এবং পারিবারিক প্রতিশ্রুতিগুলোর উপর জোর দেয়া হেয়েছে। বলা হয়েছে, পারিবারিক প্রতিশ্রুতির কারণেই নারীরা খণ্ডকালীন চাকরিতে বেশি আগ্রহী। এছাড়া জনপ্রশাসন এবং ব্যবস্থাপনা খাতে নারীদের সংখ্যা বাড়ানোর উপর জোর দেয়া হয়েছে। বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে রাজনীতিতে নারীদের সংখ্যা বাড়ানোর উপর।

এই ইস্যুতে নিজেদের প্রস্তুতির জানান এরইমধ্যে দিয়েছে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ)। স্থানীয় স্তরে ২০২৫ সাল নাগাদ দলটির শীর্ষ পদগুলোতে নারীদের জন্য ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলক কোটার ঘোষণা দিয়েছেন সিডিইউ নেতা আন্নেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার। পাশাপাশি নির্বাহী পরিষদগুলোতেও নারীদের সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল নিয়ে কাজ করছে ফেডারেল সরকার। ফলে বিদ্যমান ৩০ শতাংশ কোটা পূরণের বাধ্যবাধকতা ১০৫টি প্রতিষ্ঠান থেকে বেড়ে ৬০০ প্রতিষ্ঠানের দাঁড়াবে।

জার্মানরা বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই একজন নারী চ্যান্সেলরের অধীনে চলছে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ জার্মানি। অথচ এদেশটিতেই নারীর সমানাধিকার খুবই নাজুক। যা ইউরোপীয় মানের অনেক নিচে। আর এই তথ্য উঠে এসেছে ইউরোপীয়ান ইনস্টিটিউট ফর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটির ২০১৯ ইনডেক্সে। যেখানে বলা হয়েছে, জার্মানিতে নারীদের গড় বেতন পুরুষদের চেয়ে ২০ শতাংশ কম। এছাড়া কার্যনির্বাহী কমিটিগুলোতে নারীদের উপস্থিতি মাত্র ১৫ শতাংশ।

জার্মান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বুন্দেসটাগের দিকে তাকালেই বোঝা যায় রাজনীতিতে নারীর অংশদারীত্ব কতখানি। গেল ২০ বছরের মধ্যে বুন্দেসটাগে নারী প্রতিধিত্বকারীর সংখ্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে। স্থানীয় সরকারগুলোতে মেয়র পদে পুরুষের সংখ্যা ৯০ ভাগের বেশি। ঐতিহাসিকভাবেই দেখা যায়, ভূতপূর্ব পশ্চিম জার্মানিতে লিঙ্গ বৈষম্য ছিল বিশেষ একটি বাঁধার ক্ষেত্র। জার্মানির ওই অংশটিতে নারীদের কাজ করতে স্বামীদের অনুমতির দরকার হতো। আর এই ব্যবস্থা চালু ছিল ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত।

দুই জার্মানি পুনরেকত্রীকরণের ঠিক কিছুকাল আগে পশ্চিম জার্মানির অর্ধেক নারী জনশক্তি খাতে যোগ হয়। অথচ একই সময়ে কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে এই সংখ্যা ছিলো ৯১ শতাংশ।

জার্মান পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই মতে, চলমান করোনাসঙ্কট লিঙ্গ বৈষম্যকে অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। জুন মাসে জার্মানির ফুংকে মিডিয়াকে দেয়া সাক্ষাতকারে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারপতি এলকে বুয়েডেনবেন্ডার। বুয়েডেনবেন্ডার জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক-ভালটার স্টাইনমায়ারের স্ত্রী। বুয়েডেনবেন্ডার স্পষ্টই বলেছেন, ‘পরিবারের প্রধান বোঝাগুলো বইছে নারী।’  তার মতে, করোনাভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে সবকিছু যখন স্থবির, তখন মেয়েরাই তাদের ক্যারিয়ারের সঙ্গে আপস করে পরিবারের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু এই ত্যাগস্বীকারে পুরুষের হার নিতান্তই নগন্য।

আধুনিক জার্মান সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি এই লিঙ্গ বৈষম্য স্রেফ বেমানান। এখানে নাগরিকের অধিকার রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয় সবার উপরে। বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ঈর্ষনীয় পর্যায়ের। রয়েছে প্রথম সারির সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী। অথচ এখানেই বেতনবৈষম্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার নারী। দীর্ঘদিন ধরেই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন জার্মান নারীরা। আঙ্গেলা মেরকেল সরকারের নতুন  এই কর্মকৌশল হয়তো নারীর সমানাধিকার নিশ্চিতে জার্মানিকে এগিয়ে নেবে আরেক ধাপে।

লেখক: বিপ্লব শাহরিয়ার, জার্মান প্রবাসী

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago