আলী যাকের আলোর পথযাত্রী
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/aly_zaker_and_syed_haq.jpg?itok=_WuAIphQ×tamp=1606465446)
(এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দধারা’র ১৬-৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের সংখ্যায়)
সেলফ মেইড আলী যাকের। সফল যিনি সর্বত্র। অভিনয়ে শক্তিমান। নির্দেশনায় সৃজনশীল। করপোরেট কালচারে তিনি অধিকতর মানবিক। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি অকুতোভয় যোদ্ধা। কিন্তু, এতসব কীর্তিময় পরিচয়ের ওপরে অবস্থান মানুষ আলী যাকেরের। স্বামী, পিতা, বন্ধু-সহকর্মী— পারিবারিক ও সামাজিক নানা পরিচয়ে মানুষ হিসেবে তিনি অসামান্য।
প্রায় ৪০ বছরের কর্মজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নেপথ্যপ্রেরণা সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। আমরা আড্ডায় বসেছিলাম আলী যাকেরকে ঘিরে। ঘরোয়া এই আড্ডায় সৈয়দ শামসুল হককে পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত। বিশাল ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের মন ও মননের খবর তিনি ছাড়া আর কে ভালো জানবেন। তিনি আড্ডাচ্ছলে তুলে আনলেন আলী যাকেরের বর্ণিল জীবনালেখ্য। আড্ডা সঞ্চালক রাফী হোসেন
রাফী হোসেন: নাট্যজন আলী যাকের ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে আমরা পেয়েছি আজ আমাদের মাঝে। দুই দিকপালকে আমরা পেয়েছি। দুই অঙ্গনের মহান দুজনকে একসঙ্গে পাওয়া দুর্লভ। এটা একটা আনন্দের দিক। আরো ভালো লাগার কারণ হচ্ছে, কীর্তিমান আলী যাকেরের ৭০তম জন্মদিন সম্প্রতি শেষ করেছেন। আমরা ধন্য যে, এই রকমের দুই ভুবনের সফল দুজনকে একসঙ্গে করতে পেরেছি। এটা একটা ভালো লাগার কারণও। হক ভাইয়ের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ, হক ভাই আমাদের সময় দিয়েছেন বলে। আমরা আলোচনা শুরু করতে চাই।
আলী যাকের: আমরা গম্ভীর কথাগুলো একটু হালকা করে ফেলি। কঠিন কঠিন শব্দগুলো বাদ দিই। তুমি দিকপাল, মহান শব্দগুলো ব্যবহার করেছ, দিকপালের দিকটা হয়তো আছে, পাল নেই। আর পালের গোদা হচ্ছেন হক ভাই।
সৈয়দ শামসুল হক: ও আরেকটি বিশেষণ ব্যবহার করেছে। সেটা হচ্ছে মহান। মহানটা শরীরে ধারণ করতে চাই না। তবে সবকিছুকে একটা মহান অবস্থায় দেখতে চাই। বোধহয় আমাদের যতটুকু যার যার কাজ, করতে পেরেছি, করার চেষ্টাটা করেছি। তার মধ্যে থেকে জীবনটা যেন একটা উচ্চতা পায়, একটা বিস্তৃতি পায়, তাই না?
রাফী হোসেন: হক ভাই, আলী যাকের ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগটা কবে থেকে?
সৈয়দ শামসুল হক: ওর সঙ্গে তো আমার যোগাযোগ অনেক দিন থেকে। শিল্পের যে যোগাযোগ সেটা অনেক গভীর। হয়তো ভাই-বোনদের সঙ্গে ওইভাবে দেখা হয় না, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সেভাবে দেখা হয় না, কিন্তু শিল্পের মানুষের সঙ্গে দেখা হয় অনেকবার।
আলী যাকের: অবাক করা কাণ্ড তাই না। কেউ বুঝতে চায় না। বুঝতে পারেনি কেউ, কী করে এটা সম্ভব হয়।
সৈয়দ শামসুল হক: এই যোগাযোগটা নাটকের মাধ্যমেই।
রাফী হোসেন: সেটা কি দেওয়ান গাজীর কিসসা থেকে?
সৈয়দ শামসুল হক: না, না, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি থেকে। আমি তখন কেবল লিখতে শুরু করেছি ‘নূরলদীনের সারাজীবন’।
রাফী হোসেন: এটা নাটক কখন হয়?
সৈয়দ শামসুল হক: নাটক তখনই হয়, যখন এর পাণ্ডুলিপি, প্রযোজনা ও দর্শক— এই তিনের মিশ্রণ হয়। তখনই সেটা নাটক হয়ে উঠে।
রাফী হোসেন: আলী যাকের ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করছি ‘নূরলদীনের সারাজীবন’-এ যে প্রাণ দেওয়া, উনি যে প্যাশন নিয়ে লেখাটা লিখলেন এবং আপনার সেই দুর্দান্ত অভিনয় ও ডিরেকশন। নূরলদীনের গল্পটা যদি শুনি।
আলী যাকের: এটার নির্দেশনা আমি দিয়েছিলাম। কিছু কথা ঘটনার পেছনে থেকেই যায়। এখন নাটকটি যেটি আছে, সেটাতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বাংলাদেশের প্রধান নাটকগুলোর দুটি বা তিনটি যদি থাকে, তার সবগুলোই কিন্তু হক ভাইয়ের লেখা। কিন্তু, একটা ব্যাপার আছে। এই ভুলটা করেছিলাম অল্প বয়সে, সেই বিষয়ে এখন আমি ভাবি। যে কোনো অভিনেতার অভিনয় সুবিচার করতে হয়, যে ভূমিকায় সে অভিনয় করে, সে নাটকে তার নির্দেশনা না দেওয়াই ভালো।
রাফী হোসেন: আপনি এভাবে দুটি বিষয়ের সমন্বয় করেছেন কীভাবে?
আলী যাকের: এটা আমার অরিজিনাল ব্যাপার না। বাল্যকাল থেকে যেসব নাটক কলকাতায় দেখে আসছি, যে নাটকগুলো আমাকে মুগ্ধ করেছে, বিভিন্ন সময়ে। আমার নানাবাড়ি কলকাতায়। সেই সূত্রে কলকাতার নাটক প্রচুর দেখা হয়েছে। শম্ভু মিত্রের নাটক দিয়ে ছোটবেলায় নাটক দেখা শুরু। প্রত্যেক গ্রীষ্মে নানাবাড়িতে চলে যেতাম বেড়াতে। তারপর মা আমাকে থিয়েটারে নিয়ে যেতেন। প্রথম দেখি সম্ভবত ‘রক্ত করবী’। এই তো শুরু হলো। তারপর কলকাতায় প্রচুর নাটক দেখেছি। ওখানে প্রধান অভিনেতা আবার নির্দেশনাও দিতেন। সেসব নাটক দেখার অভিজ্ঞতা চমৎকার।
সৈয়দ শামসুল হক: আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে বোধহয় দু-একজন আছে, যাদের কক্ষে কক্ষে ভাগ করা সব। তার মধ্যে আলী যাকের অন্যতম। আমার জীবনের অসম্ভব ভালো একজন বন্ধু সে।
আলী যাকের: কার কোন কবিতা কবে যেন পড়েছিলাম, মাথার মধ্যে কতগুলো ঘর থাকা ভালো।
সৈয়দ শামসুল হক: হা হা হা। এবং শুধু অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়ে নয়। ও নিজেকে বিচিত্র কাজের সঙ্গে জড়িয়েছে। সব কাজে সফলতা পেয়েছে।
রাফী হোসেন: এটা আমরা এক এক করে আসব।
সৈয়দ শামসুল হক: আলী যাকেরকে আমরা দেখি, ও যখন যেটা করে একেবারে কক্ষে কক্ষে ভাগ করে করে।
রাফী হোসেন: তারপর কি থিয়েটারের নাটকে টানা ডিরেকশন দেননি?
আলী যাকের: বেশিরভাগ নাটক আমার ডিরেকশন দেওয়া। ডিরেকশনটা আগে চিন্তা করা হতো, তারপর অভিনয়ের চিন্তা ও অভিনয় করা। মানে নিজে ডিরেকশন দিলে মনে হয় যে, এই বিশেষ চরিত্রটিতে অভিনয় করার লোক আর নেই। এটাও আমাদের আরেকটি সীমাবদ্ধতা। ওখান থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে সেটাই হয়।
সৈয়দ শামসুল হক: তবে মঞ্চে আলী যাকেরের শ্রেষ্ঠ কাজ যদি বলি, সেটা অভিনয় এবং অভিনয়। এটা ওর সামনেই বলছি আমি। নির্দেশনার চেয়ে অনেক ওপরে ওর অভিনয়। গ্যালিলিও নাটকের কথা বলছি। আহা, আমি তো কখনো ভুলতে পারব না। কী অসাধারণ অভিনয়! আমার তো মনে হয় যদি প্রতিরাতে এখনো গ্যালিলি মঞ্চায়ন হয় এবং আমি প্রতিরাতেই গ্যালিলিও দেখতে যাব। গ্যালিলিও মিস করব না। আলী যাকেরের অসাধারণ অভিনয় মিস করব না। এমন অসাধারণ পারফরম্যান্স মিস করা যায় না। গ্যালিলিও নাটকে বাচ্চা রাজার চরিত্রে আলী যাকেরের ছেলে ইরেশ অভিনয় করত। সেখান থেকে আজকে ইরেশকে যখন দেখি, আমার কাছে ভীষণ অবাক লাগে। নূরলদীনের কথা আবারও বলছি। নূরলদীনের ইতিহাস পুরনো। তাকে সবাই ভুলে গিয়েছিল।
রাফী হোসেন: আলী যাকেরের অভিনয়ে তা জীবন্ত হলো।
সৈয়দ শামসুল হক: জীবন্ত নয়, নূরলদীনের নতুন করে জন্ম হলো।
আলী যাকের: ‘জাগো বাহে কণ্ঠে সবাই…’ সেই বিখ্যাত একটি কথা, বিখ্যাত সেই আহ্বান। এটি তো আজকালকার রাজনীতিবিদরাও সবাই ‘জাগো বাহে’ বলেন। সবাই ‘জাগো বাহে’ বলে থাকেন সবখানে। এটা বলে তারা আবার সেই পুরনো পথেই পা বাড়ান। হা হা হা।
সৈয়দ শামসুল হক: হা হা হা।
রাফী হোসেন: এই যে হক ভাই এত সুন্দর করে বললেন। আসলে ভালো অভিনেতার সংজ্ঞা কী? আপনি কী বলেন?
আলী যাকের: ভালো অভিনেতা সেই, যে নাকি লিখিত নাটককে অতিক্রম করতে পারে। এটা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে, লেখাটার যে লাইনগুলো দেওয়া হয়েছে, সে লাইনগুলোর মধ্যে থেকে সে কী দেখতে পায়। আমার কথাগুলো হয়তো অন্যরকম শোনাবে। কিন্তু, কথাগুলো সত্যি। আমি যদি ‘নূরলদীনের সারাজীবন’র একটি সংলাপ ধার করে বলি, যখন নূরলদীন বলছে… ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ করব। তখন আব্বাস বলছে, ভাবি দেখ নূরলদীন। এখানে পূর্ণিমা চাঁদ আর জননীর দুধের যে উপমা! কী দুর্দান্ত সে কথা।
সৈয়দ শামসুল হক: একজন বড়মাপের অভিনেতাই পারে ভালো ডিরেকশন দিতে। বন্ধু হিসেবে আলী যাকেরের তুলনা হয় না। অভিনেতা হিসেবেও অসাধারণ। ডিরেকশনও দেন ভালো। এত বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। আমার হাতে যে ঘড়িটা পরে আছি এটা ওরই দেওয়া।
আলী যাকের: কত বড় উপলব্ধি থাকলে একজন মানুষ লিখতে পারে… পূর্ণিমার চাঁদ বড় হয়রে তার জননীর দুগ্ধের…। আমি বাড়িয়ে বলছি না। এত বড় উপমা! সামনেই বলছি কথাগুলো। পাশেই বসে আছেন হক ভাই। কয়জন লেখক আমাদের এখানে আছেন, এদেশে আছেন, এই ধরনের উপমা দিতে পারেন। বোধ আনতে হবে। প্রথমে তো বোধ আনতে হবে, তারপর না হয় লেখা। লিখে ফেললাম তাতেই তো হবে না। বোধের ব্যাপার।
সৈয়দ শামসুল হক: আলী যাকের, নাটকটি আমি যখন লিখেছি, তখন আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
আলী যাকের: একটা ঘোরের মধ্যেই নাটকটি লিখেছিলেন।
সৈয়দ শামসুল হক: ঘোরটা কাজ করা দরকার। তেমনি আমি বলব আলী যাকের যখন মঞ্চে অভিনয় করে, তখন তার মধ্যে এক ধরনের ঘোর কাজ করে। আলী যাকের অভিনয় করেন, নির্দেশনা দেন, মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, ব্যবসা করেন, আবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি।
আলী যাকের: সবটার মধ্যেই আবেগ কাজ করে। হক ভাই একটা ঘোরের মধ্যে, একটা ইমোশন নিয়ে নাটকটি লিখলেন। প্রতিবার যখন নাটকটি করেছি একটা অন্যরকম ভালোলাগার মধ্যে গেছি। শেষবার যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মঞ্চায়ন করি, ওইখানে গিয়ে আমি উপলব্ধি করতে পারলাম, আপনার ওই চরণগুলো কত ভেতর থেকে আসলে লেখা। কী প্রচণ্ড ইমোশন দিয়ে লাইনগুলো লেখা।
সৈয়দ শামসুল হক: একবার নাটকটি দেখতে গিয়ে কী হলো বলি। আলী যাকেরের সেই দিনটিতে অভিনয়ের কথা ভোলার নয়। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। আমি একটা সময়ে চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি ওর অভিনয় দেখে। এত আবেগ, এত দরদ দিয়ে অভিনয়। চোখ দিয়ে অশ্রু পড়ছিল।
রাফী হোসেন: এই যে দুজনার যৌথ প্রয়াসে ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ একটা অসাধারণ সৃষ্টি হয়ে উঠল, দুজনেরই সমান অবদান, এরপর হক ভাইকে আপনারা বলেননি এ রকম নাটক আরো একটা দেন। তারপর ‘ঈর্ষা’ নাটকে বোধহয় হক ভাইয়ের লেখা দেখলাম।
সৈয়দ শামসুল হক: আমার স্ত্রীর ভাষায় আলী যাকের হচ্ছেন একজন মহাদেব। আমার স্ত্রী বলেন— আমি মহাদেব দেখিনি, আমি আলী যাকেরকে দেখেছি। তাহলে বুঝতে হবে আলী যাকেরের স্থান কোথায়। কত বড় মাপের মানুষ সে।
আলী যাকের: আমি শুনিনি আগে। আজকে যেতে হবে সালাম করতে। হা হা হা।
রাফী হোসেন: আচ্ছা হক ভাই, আপনার দেখা আলী যাকেরের শ্রেষ্ঠ কাজ কোনগুলো? মঞ্চ, টেলিভিশন সব জায়গায়।
সৈয়দ শামসুল হক: সব মিলিও না। মঞ্চটাই আসল। ‘গ্যালিলিও’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকের কথা বলতে হয়। আমি টেলিভিশন ও সিনেমার অভিনয়কে মিলিয়ে আনতে চাই না। আমি মনে করি, আলী যাকেরের মূল জায়গা মঞ্চে। মঞ্চে নাটক দেখার যে টেস্ট, এটা কোথায় পাওয়া যাবে? মঞ্চে জীবন্ত মানুষের অভিনয় সামনে বসে দেখা যায়। এখানেই আলী যাকেরের জায়গা। তারপরও বলতে চাই, আমি আলী যাকেরকে সারাজীবন দেখেছি নাটকের মানুষ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, আমার স্ত্রীর ভাষায় যে কিনা মহাদেব। সব মিলিয়ে আলী যাকের একজন কর্মিষ্ঠ মানুষ। এত কাজ করতে পারে!
রাফী হোসেন: আপনি মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন?
আলী যাকের: আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে যাই, তখন আমি চাকরি করতাম। তার আগে দেশের যত আন্দোলন হয়েছে, সবগুলোতে থাকতে পেরেছি। এটা সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানি না। এ কথাটা সত্যি, আমরা কখনই রাজনীতি থেকে নিজেদেরকে বিচ্যুত করতে পারিনি। ’৬৯ সালে যখন গণঅভ্যুত্থান হয়, তার সঙ্গেই ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা বিভিন্নভাবে এর সঙ্গে জড়িত হয়েছি। ২৫ মার্চ রাতের বেলা শহীদ মিনারের সামনে ছিলাম কিছুটা সময়। ওখানে আমরা আড্ডা মারতাম। সিদ্ধান্ত নিতাম কী করা যায়। তারপর হঠাৎ করে সব থেমে গেল। বলাই, কেন্টিনের বলাই এসে বলল, বোধহয় বিপদ হতে পারে।
রাফী হোসেন:শহীদ মিনারে কি নাটক করছিলেন তখন?
আলী যাকের: না, না। ওই সময়ে হাসান ইমাম ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত নানা ধরনের প্রোগ্রাম হতো শহীদ মিনারে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধের নাটক, গান-বাজনা হতো। বলাই বলল, আপনারা চলে যান। আমরা বাসায় যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি হয়ে বাসায় যাই। সেখানে যাওয়ার পর দেখি কোনো লোক নেই।
রাফী হোসেন: বলছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা?
আলী যাকের: ও, হ্যাঁ। তখন রাজারবাগে থাকি। বাসায় আসতে আসতে রাত ১১টা বেজে গেল। অমি বোধহয় দুশ গজ দূরে ছিলাম। মোমেনবাগ বলে একটা জায়গা সেটা। সচক্ষে দেখেছি সেই নির্মমতা। রাজারবাগকে শেষ করে দেওয়া হলো। আগুন দেওয়া হলো। পুলিশরা যে কয়জন বেঁচে ছিল চলে গেল। সকালবেলা দুজন লুঙ্গি পরা লোক এলো। আমার হাতে দুটি রাইফেল দিল। দিয়ে বলল, এগুলো রেখে দেন। আমাদের সহকর্মীরা সব মরে গেছে। আমরা আবার আসব। চলে যাচ্ছি। গুলি ফুরিয়ে গেছে। আর থাকা সম্ভব না। কী অসাধারণ অবদান তাদের। আমি বাড়ির ভেতরে ঢুকে কুয়োর পাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদলাম। সেই দিনই আমার মনে হলো— কী হবে আমাদের? আমাদের চোখের সামনে আমরা দেখতে পাব বাংলা নাম উঠে যাচ্ছে। উর্দু হবে। দেখতে পাব বাংলা সাইনবোর্ড নেই। এই রকম সর্বৈব একটি পরাধীন দেশে বা শহরে আমি থাকব কী করে? এই ইচ্ছে নিয়ে বের হয়েছিলাম... এই দেশে আর না। পরাধীন দেশে আর না। আমি থেকে যেতে পারতাম। আমি ভালো একটা চাকরি করতাম। কিন্তু, মন টানছিল না। তারপর জানতাম না মুক্তিযুদ্ধে যাব। জানতাম না স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাব। কিছুই জানতাম না। চলে গেলাম। কোনো আপস করব না বলে গেলাম।
সৈয়দ শামসুল হক: আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধে আলী যাকেরের যাওয়া সেটা ভেতরের তাগিদ থেকে যাওয়া এবং ভেতরের জাগরণ থেকে যাওয়া।
আলী যাকের: ওই আক্রমণের পর কিন্তু আমার ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ জন্ম নিল। ওই ক্রোধ বলেছে, তোমাকে প্রতিশোধ নিতে হবে। আপস নয়। আপস করা যাবে না।
সৈয়দ শামসুল হক: ক্রোধ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ এটা ব্যাপক কাজ করে। এটা আলী যাকেরের ব্যক্তিগত জীবনকাহিনী। যুদ্ধ আমরা জয় করেছি। আলী যাকেরের সমাজ ভাবনা, রাজনীতি ভাবনা, বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় কলাম লেখা এসবই তার জীবনের অংশ। এসব সে পারে সুন্দরভাবে করতে।
রাফী হোসেন: লেখক আলী যাকেরকে মূল্যায়ন করবেন কীভাবে? কিংবা যদি লেখক আলী যাকেরকে মূল্যায়ন করতে বলি?
আলী যাকের: আমি খুবই কুণ্ঠাবোধ করছি। বাংলাদেশের প্রধান একজন লেখককে বলা হচ্ছে আমার অকিঞ্চিৎকর কাজের মূল্যায়ন করতে।
সৈয়দ শামসুল হক: মূল্যায়ন শব্দটি ঠিক নয়। মূল্যায়ন না। কিন্তু, আমাকে যে কজন লেখকের লেখা টানে, যে কজন লেখকের লেখা পড়ি, তাদের মধ্যে আলী যাকের একজন। তা থেকেই বোঝা যায় আলী যাকেরের লেখার গভীরতা। তার লেখা মন দিয়ে পড়ি। আমাকে টানে শুধু নয়, তার লেখা আমাকে সমৃদ্ধ করে, কখনো তার লেখার ভাষা ও উপমা আলোড়িত করে। বিশেষ করে তার আত্মজীবনী অসাধারণ একটি লেখা। তাছাড়া, আলী যাকেরের লেখা আমার কাছে খুবই সাবলীল মনে হয়। আলী যাকের নট অনলি একজন অ্যাক্টর। নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। সবটা মিলিয়ে বলব মহাদেব।
রাফী হোসেন: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর কিছু বলার আছে?
আলী যাকের: এই তো। মুক্তিযুদ্ধ করেছি। নাটক তো করছি, কাজেই নাটকীয়তা শোনাবে। তুমি যদি দেখতে পাও তোমার মা আক্রান্ত হয়েছে, তার জন্য যুদ্ধ করা নয় কেন? এখানে তো কোনো প্রশ্ন আসে না। এখানে কোনো আপসের ব্যাপার কাজ করে না। যুদ্ধ করতে মন চেয়েছে, করেছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। চলে এসেছি। কিন্তু, অনেকে আছেন হয়তো, যারা যুদ্ধ শেষের পাওনা চান। এই যুদ্ধটা তো আমার মায়ের জন্য। যুদ্ধটা তো করেছি মায়ের জন্য। মায়ের কাছে কী চাইব! আমি যেখান থেকে গিয়েছিলাম, সেখানেই ফিরে এসেছি।
সৈয়দ শামসুল হক: অনেকেই একটা আন্দোলনে নেমে, জয়যুক্ত হওয়ার পর বলেন, কী পেলাম? আরে তুমি যে তুমি হয়ে আছ এটাই তো অনেক। কিছু মানুষ আছে পাওনাটা বুঝে নিতে চায়। বোঝে না। মুক্তিযুদ্ধে আলী যাকেরের অবদান, বাঙালি হিসেবে বেঁচে আছি, এটাই তো বড় পাওনা।
রাফী হোসেন: মঞ্চে কি আর ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে?
আলী যাকের: হ্যাঁ, আমার দেহ যদি বিট্রে না করে। খুব শিগগিরই তাহলে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
রাফী হোসেন: হক ভাইকে ধন্যবাদ। হক ভাই, কখনো মনে হয় আলী যাকেরকে নিয়ে এই সময়ে আরো একটা অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করা যায়?
সৈয়দ শামসুল হক: আমি নিজেও বহু বছর ধরে এটা ভাবছি, আলী যাকেরকে নিয়ে কিছু করা যায় কিনা। দেখো আমার লিখতে কিন্তু অনেক সময় লাগে। লোকে ভাবে, দুই ঘণ্টার নাটক হুট করে লিখে ফেলা যায়। হুট করেই লিখে ফেললাম, তা নয়।
রাফী হোসেন: আমরা আশা করছি হক ভাই খুব দ্রুত লেখাটা শেষ করবেন এবং আলী যাকের সেখানে প্রাণ দেবেন?
আলী যাকের: আবার জন্ম নেব।
সৈয়দ শামসুল হক: আবার জন্ম নেব।
রাফী হোসেন: আশা করছি খুব দ্রুত আমরা সেটা দেখতে পাব। আচ্ছা, কেন টেলিভিশন ও সিনেমা সেভাবে আপনাকে টানে না? মঞ্চ নিয়েই কেন?
সৈয়দ শামসুল হক: এসব প্রশ্ন করো না। আমি তো বলেছি জীবন্ত মানুষ, জীবন্ত মানুষের সঙ্গেই থাকে। জীবন্ত মানুষ বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো হয় মঞ্চে।
আলী যাকের: দারুণ বলেছেন হক ভাই। বিদ্যুৎ প্রবাহ। এটাই কিন্তু হয়। নিজে যিনি অভিনয় করেন তার গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে।
রাফী হোসেন: আপনাদের কি মনে হয় মিডিয়ার প্রভাবে থিয়েটার হারিয়ে যাবে?
আলী যাকের: না, না। কখনই না।
সৈয়দ শামসুল হক: থিয়েটার আমাদের একটা বিরাট শক্তি। এটা পৃথিবী থেকে হারাবে না।
আলী যাকের: হ্যাঁ।
Comments