রাগাশ্রয়ী গানের দিকে ঝোঁকটা একটু বেশি: আলী যাকের

আমাদের বাড়িতে গান শোনার বাতিক ছিল সবার। আমার মা নিজে অর্গান বাজিয়ে বাজিয়ে গান গাইতেন। পায়ে প্যাডেল করা অর্গান দুহাতে বাজাতে হয়। এটা বাজিয়ে নজরুলগীতি গাইতেন। আমার দিদি মিন মিন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, বাথরুম শিল্পী বলতে যা বোঝায় সেটা। দিদি সেতার বাজাতে শিখছিলেন। ঢাকায় এসেও সেতার বাজাতেন। সেই বাড়িতেই আমার জন্ম। বাল্যকাল থেকে মায়ের কাছ থেকে শুনে এসেছি নজরুলের বিভিন্ন গান। পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত। দিদির কণ্ঠে শুনেছি কানন দেবীর গান। ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। দিদির খুব প্রিয় গান ছিল ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। আমার দিদিটার নাম ছিল নুটু। দিদি মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে মারা যান। তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।
Aly Zaker with Wahidul Haq-1.png
সংগীত ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে আলী যাকের।

(এই সাক্ষাৎকারটি আনন্দধারা’র ১৬-৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল)

আমাদের বাড়িতে গান শোনার বাতিক ছিল সবার। আমার মা নিজে অর্গান বাজিয়ে বাজিয়ে গান গাইতেন। পায়ে প্যাডেল করা অর্গান দুহাতে বাজাতে হয়। এটা বাজিয়ে নজরুলগীতি গাইতেন। আমার দিদি মিন মিন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, বাথরুম শিল্পী বলতে যা বোঝায় সেটা। দিদি সেতার বাজাতে শিখছিলেন। ঢাকায় এসেও সেতার বাজাতেন। সেই বাড়িতেই আমার জন্ম। বাল্যকাল থেকে মায়ের কাছ থেকে শুনে এসেছি নজরুলের বিভিন্ন গান। পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত। দিদির কণ্ঠে শুনেছি কানন দেবীর গান। ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। দিদির খুব প্রিয় গান ছিল ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। আমার দিদিটার নাম ছিল নুটু। দিদি মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে মারা যান। তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।

ঢাকায় যখন এলাম ১৯৫৩ সালে। ঢাকার গেন্ডারিয়ায় বাবা তার জীবনের প্রথম বাড়ি কিনলেন। সেই বাড়ির একটা কোণায় মায়ের অর্গানটা লাগানো হলো। সেখানেও বিস্তর গান-বাজনা হতো। দিদি যেতেন বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে। দিদি এখানে খাদেম হোসেন খান সাহেবের কাছে সেতার শিখতেন। আমি এবং আমার ছোট বোন কলকাতার আকাশবাণীর রবিবারের অনুরোধের আসরের পোকা ছিলাম। নিয়মিত শুনতাম এবং চিঠিও লিখতাম। সেখানে নিজের নাম পড়ে শোনানো হলে ভীষণ মর্যাদার মনে হতো। আমি কিন্তু বাল্যকালে পঙ্কজ মল্লিকের গান পছন্দ করিনি। আমার প্রথম পছন্দ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বহুদিন হেমন্ত ছিল আমার মনের ভেতরে। যখন কলেজে উঠি মানবেন্দ্র হেমন্তকে ওভারটেক করে যায়। ধীরে ধীরে মান্না দে, শ্যামল মিত্র প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। মান্না দের গাওয়া ‘এই পারে আমি আর ওই পারে তুমি, মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়’ খুব ভালো লাগত। তখনো ‘কফি হাউজের ওই আড্ডাটা’ গাওয়া হয়নি।

আমার বাবা-মায়ের খুবই প্রিয় ছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। মা অর্গান বাজিয়ে গান গাইতেন ‘মরমিয়া তুমি চলে গেলে, দরদিয়া বলো কোথা পাবো, কারে আমি এ কথা জানাবো’। আমার বাবা যখন চলে গেলেন ১৯৬১ সালে, তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। অফিসে যাচ্ছিলেন গাড়িতে করে। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। মা এই গানটা নিয়মিত গাইতেন এবং দরদর করে দুই চোখ দিয়ে পানি পড়ত। এরপর খুব অল্প বয়সে মারা গেলেন। তখন মায়ের বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন আমার মা। সেই কথা থাক। আমাদের বাড়িতে কিন্তু গানের চলটা সব সময়ই ছিল।

আমার বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। ভোরবেলা নামাজ দিয়ে শুরু এশার নামাজ দিয়ে শেষ। ভোরবেলা ৪টার সময় ওঠে তাহাজ্জত নামাজ পড়তেন। কোরানের তরজমা করতেন, দাগাতেন, নোট করতেন। হি ওয়াজ এ ভেরি এনলাইটেন্ড মুসলিম। কিন্তু গানের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। বিশেষ করে আমার মায়ের গাওয়া গান। সতীনাথ, মানবেন্দ্রের গানগুলো। ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার।’ এ গানগুলো বাবা শুনতে খুবই পছন্দ করতেন। আমাদের বাড়ি সংগীতের প্রতি খুবই সেনসেটিভ একটা বাড়ি। বাল্যকাল থেকে গান শুনে আসছি। একটা ফোর ব্যান্ড রেডিও কিনে দিয়েছিলেন বাবা। সেখানে আমরা কলকাতা, রেডিও সিলন শুনতাম। সেখানে হিন্দি গান ভালো শোনা যেত। এগুলো নিয়মিত শুনতাম। জোরে বাজিয়ে গান শোনা হতো। আমাদের বাড়িতে গান শোনাতে কোনো বাধানিষেধ ছিল না। মিউজিক আমাদের জীবনের অংশ ছিল সব সময়।

আনন্দধারা: বাল্যকাল, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে এখন কি গান শোনার বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়েছে? একেক সময় একেক ধরনের গান ভালো। সেই বিষয়টি যদি বলেন।

আলী যাকের: যা দিয়ে শুরু করেছিলাম এখনো সেসব গান শুনি। সেই গানগুলোই এখনো গুনগুন করি। তখন মানবেন্দ্র, হেমন্তের গানগুলো শুনতাম, এখন সেই গানগুলোই শুনি শ্রীকান্ত আচার্যের কণ্ঠে। শুধু কণ্ঠটা পরিবর্তন হয়েছে। আমার গানের রুচির পরিবর্তন হয়নি। সেই একই গান শুনি।

আনন্দধারা: যাপিত জীবনে অনেক ধরনের গান শুনেছেন। অনেক কণ্ঠের মাধুর্য আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। চলতি সময়ে কাদের গান ভালো লাগে এবং প্রিয় কণ্ঠশিল্পীর নামগুলো যদি বলেন?

আলী যাকের: ব্যান্ডের শিল্পীদের মধ্যে বাপ্পা মজুমদারের গান আমার খুবই ভালো লাগে। রবীন্দ্রসংগীতে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মিতা হকের গাওয়া গান আমার ভীষণ প্রিয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের অদিতি মহসীনের গাওয়া গান আমার ভালো লাগে। লাইসা আহমেদ লিসা আমার প্রচণ্ড প্রিয়। একেবারে নতুনদের মধ্যে জয়িতার গান ভালো লাগে।

শ্রীকান্ত আচার্যের গান অসম্ভব প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতে। নজরুল সংগীতে খায়রুল আনাম শাকিল আমার খুব প্রিয়। আমার ভাই মাহমুদুর রহমান বেনু এখন গান গায় না, সে এখন লন্ডন প্রবাসী। ওর কাছেই শাকিল গান শিখেছে। মাহমুদুর রহমান বেনুর গাওয়া নজরুলগীতি এবং ধ্রুপদী ঢংয়ের কিছু গাছ আছে, সেগুলো আমার ভীষণ প্রিয়। রবীন্দ্রনাথের কিছু ধ্রুপদী ঢংয়ের গান আছে যেগুলো আমার খুবই প্রিয়। মা যেহেতু নিজে গাইতেন, নিজে বাজাতেন, তাই রাগাশ্রয়ী গানের দিকে ঝোঁকটা আমাদের একটু বেশি।

আনন্দধারা: সকালের শুরু থেকে রাতের ঘুম অবধি কোন গানগুলোর সঙ্গী থাকেন। গান শোনার মুহূর্তগুলো কখন?

আলী যাকের: একটা বিষয় ইদানীং আমার ভালো লাগছে। রবীন্দ্রসংগীতের রাগ রূপটা সেটা তাল সহকারে গাওয়া হচ্ছে এবং সেটা পরিবেশন করা হচ্ছে। এটা নতুন একটা ধারা শুরু হয়েছে। অনেক মানুষ এটা পছন্দ করেন না। তারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথের গান এতে বিকৃত হয়। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে বলতে পারতেন পছন্দ করেন কি করেন না। আমার কিন্তু ভীষণ ভালো লাগে। নিয়মিত এই গানগুলো শুনি। রশীদ খান, অলকা ইয়াগনিক, শ্রাবণী সেনের গাওয়া এই গানগুলো আমাকে দারুণ স্পর্শ করেছে। এই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট আমার ভালো লাগে। যদি রবীন্দ্রনাথের স্বরলিপি ছেড়ে চলে না যায়। তাহলে ভীষণ ভালোবাসি এই গানগুলো। সাধারণত অধিক রাতে গান শুনি। আমার ল্যাপটপে শুনি। আর না হলে গাড়িতে শুনি। গাড়িতে অনেক গান শোনা হয়।

আনন্দধারা: কবিতার প্রতি আপনার টান রয়েছে কি, কবিতা পড়া হয়?

আলী যাকের: নিয়মিত কবিতা পড়া হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার প্রতিটি লেখা গোগ্রাসে গিলি। সেখানে কবিতা থাকে, কবিতা পড়ি। একটা খরা এসেছে বাংলা সাহিত্যে, সেটা কেটে যাওয়া ভালো। সেদিন যখন কাইয়ুম চৌধুরী ভাই শুয়েছিলেন শহীদ মিনারে। ওখানে মন্তব্যের জন্য একটা খাতা রাখা ছিল। তাতে আমি দুটো লাইন লিখেছিলাম। ‘ছিলেন, নেই, ব্যস এই’। এটা জয় গোস্বামীর কবিতা। কবিতায় অবশ্য লেখা ছিল, ‘ছিল, নেই, জীবন তো এই।’ জয় গোস্বামী আমার প্রিয় কবি। তবে  বর্তমানে আমার সবচেয়ে প্রিয় শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব সময়ের জন্য আধুনিক। এর বাইরে গিয়ে আধুনিকতা খোঁজার মানে নেই। জীবনানন্দ দাশের সব ধরনের কবিতা আমার ভালো লাগে। আমাকে আলোড়িত করে। যখনই মন খারাপ থাকে আমি ‘রূপসী বাংলা’ খুলে পাঠ করি, আবৃত্তি আমার হয় না পাঠ করি। মন খারাপের সঙ্গে কবিতা পড়ার একটা গভীর সম্পর্ক আছে।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago