আত্মপরিচয়ের বিদ্যাপীঠ জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক
ইতিহাস বলে বাঙালি মুসলমানের জাগরণ উনিশ শতকের শুরুতেও ঠিকঠাক ঘটেনি, যেমনটা ঘটেছিল হিন্দু ব্রাহ্মণদের। কারণ তাদের ছিল রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিহারীলাল ও রবীন্দ্রনাথ। আমাদের মূলত জাগরণ শুরু হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও কাজী নজরুল ইসলামের হাত ধরে। তারা গতানুগতিক ভাবনা সরিয়ে বিভিন্ন সংস্কারধর্মী, উদ্দীপনাময় রচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসর গোষ্ঠীকে জাগিয়ে তুলতেও আন্তরিক হন। যদিও তার আগে গদ্যে মীর মশাররফ হোসেন, কাব্যে কায়কোবাদ ও সামাজিক জাগরণে মুনসী মেহেরুল্লাহ ও ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভূমিকা রেখেছেন। তাদেরই হালাল উত্তরাধিকার হিসেবে মাটি মানুষের গন্ধ নিয়ে আসেন আবদুর রাজ্জাক।
বাংলা ভাষাভাষী বিদগ্ধ পাঠকরা চিনেন জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক হিসেবে। ঢাকার সমাজে জাতীয় এই অধ্যাপক ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম- এক অসামান্য দরদী মানুষ। বিদ্যানুরাগে সমকাল থেকে অগ্রগামী, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় তিনি হয়ে আছেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। পাণ্ডিত্যে, জ্ঞানে ও দেশের মঙ্গল কামনায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সমাজ সংস্কৃতি পঠন-পাঠনের ঈর্ষণীয় ব্যাপ্তি তাকে দেশ বিদেশের সারস্বত সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। সবচেয়ে সুখের বিষয় তিনি আমৃত্যু ছিলেন শিক্ষকতায়। জ্ঞান বিনিময় ও বিদ্যার্থীদের মধ্যে নিত্য নব জিজ্ঞাসা সঞ্চারে, তারুণ্যের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার কর্মকে ব্রত হিসেবে নিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন মানুষের মনোজগতের চির প্রাণময় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। হাজার হাজার বিদ্যার্থী তার পাঠে, অনুপ্রেরণায় নিজেদের করেছেন সমৃদ্ধ।
জ্ঞানপিপাসা, পাঠাভ্যাস এবং শিক্ষাদানে তার মতো তুল্য কোনো ব্যক্তি ছিল না তার সমকালে বাংলাদেশে। জনশ্রুতি আছে আবদুর রাজ্জাক শিক্ষকদেরও শিক্ষক।
একবার জাদুঘরে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। প্রধান আলোচক হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে বলতে শুনি- মানুষ মাত্রেরই একাধিক পরিচয় থাকে। প্রসঙ্গক্রমে যেকোনো একটি পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু সেটিই তার একমাত্র পরিচয় নয়। আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় নাও হতে পারে। বাংলায় মুসলমান আগমনের সময় থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আমরা দেখি, ধর্মীয় পরিচয় বেশ গুরুত্ব লাভ করেছে। কিন্তু হিন্দু বললেই সে পরিচয় পূর্ণ হতো না। তার বর্ণ, অঞ্চল, পেশা না বললে পরিচয় সম্পূর্ণ হতো না। তেমনি বাংলার মুসলমান সমাজেও নানা রকম ভাগ ছিল। সেই ভাগের, আত্মপরিচয় সংকটে থাকা মানুষের জীবনযাত্রা ও প্রেক্ষাপট নিয়ে সারাজীবন ভেবেছেন আবদুর রাজ্জাক।
জ্ঞানতাপস নিজে বলতেন, দেশ মানে দেশের মানুষ। মানুষ হইল গিয়া দেশের আসল শক্তি। দেশের মানুষগরে আপনারা ডেড ওয়েট কইরা থুইছেন। আমাগ দেশের মানুষের একটা বিশেষ যোগ্যতা যা দিয়ে ইন্টারন্যাশনালি যেকোনো দেশের মানুষের লগে তারা কমপিট করবার পারে।
সম্ভবত ১ জানুয়ারি ১৯১২ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া গ্রামে জন্ম হয় আবদুর রাজ্জাকের। সম্ভবত এই জন্য বলা কারণ, জন্মের বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছেন ১৯১২ কিংবা এর আশেপাশেই ১/২ বছর এদিক-ওদিক হতে পারে। নিজের সঠিক তারিখ না জানায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১ জানুয়ারিকে নিজের জন্মের তারিখ বলে গণ্য করতেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। তার বাবা মৌলভী আব্দুল আলী ব্রিটিশ ভারতের পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর। মায়ের নাম নান্নু বিবি।
বাবার ছিলে পুলিশের চাকরি। তাই বদলী জনিত কারণে ছেলেবেলায় নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো ও পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন। তার জন্মের বছর বাবা ছিলেন রংপুরে। তাই শৈশবের কিছুটা রংপুরে তারপর চলে যান হুগলী। হুগলী জেলার পান্ডুয়ার এক মাদ্রাসায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী এবং সেখানকারই এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতেও পড়েন।
মায়ের অসুস্থতায় আবদুর রাজ্জাককে আবার কলাতিয়ায় চলে আসতে হয়। এখানের মাইনর স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। এর মাঝেই রাজ্জাকের মায়ের মৃত্যু হয়। বাবা আবার হুগলী চলে যাওয়ায় চাচার তত্ত্বাবধানে ঢাকার মুসলিম হাইস্কুলে ভর্তি হন অষ্টম শ্রেণীতে। এখান থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (ঢাকা কলেজ) থেকে মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে ইন্টার পাশ করেন। এরপর ১৯৩১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক করেন। ১৯৩৫ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও তিনি সে বছর অংশগ্রহণ করেননি। পরে ১৯৩৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরই অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। পরে অবশ্য অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ভেঙে দুটি পৃথক বিভাগ হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান। মূলত তারপরেই শুরু হয় বিভিন্ন বিষয় লেখাপড়া।
দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের প্রতি রাজ্জাক স্যারের একটা লোভ ছিল। শুধুই দেশের নীলক্ষেতই না, পিএইচডি করার সময়ও তিনি বিদেশের পুরনো বইয়ের দোকানে যাওয়াটা নিজের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন। একদিন বিকালে গেলেন একটি দোকানে। একটি বই পছন্দ করে সেখানেই পড়া শুরু করেন। দোকান বন্ধের সময় হয়ে এলে দোকানী দোকান বন্ধ করে চলে যায়। সেই রাতটা তার সেই দোকানেই কেটেছিল।
অন্যদিকে দেখতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো ছোটখাটো মানুষ ছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। তার ক্ষীণ কাঠামোতে সত্তর বছর ধরেই বেশি মেদ-মাংস জমতে পারেনি। মুখে একগুচ্ছ দাড়ি, চশমার ভেতরে দীপ্ত দুটি চোখ। শীতেও কমদামের পাজামা-পাঞ্জাবি-চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকতেন। সুহৃদরা বলতেন জ্ঞানতাপস- কথা বলতে বলতে হেসে উঠতেন, শব্দ শুনে মনে হয় তার ভেতর খলখল করে উঠছে নিষ্পাপ শিশু। সারা মুখে চোখে ছড়িয়ে পড়ছে সারল্যের দ্যুতি। কথা বলেন ভরাট স্বরে। কখনোই বিশুদ্ধ চলতি বাংলা বলেন না। আঞ্চলিক, চলতি বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে থাকেন... আটপৌরে কথা বলেন ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায়... একটি বিশাল কক্ষে তিনি একলা থাকেন– চিরকুমার ও বয়স্ক জ্ঞানতাপস বিশাল কক্ষটিতে নিঃসঙ্গ ঋষির জীবনযাপন করে যাচ্ছেন বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। শুধুই জ্ঞানের জন্যে সব ত্যাগ করে তিনি হয়ে উঠেছেন এই সময়ের জ্ঞানতাপস। পড়ার বিষয় বিশ্বকোষ ছাড়াও সাহিত্য, অর্থনীতি, শিল্পকলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, দাবা ও আরও অজস্র বিষয়।
গবেষক মনসুর মুসা লিখেছেন, মাতৃভাষাকে লেখার মাধ্যম করার জন্য তার উৎসাহ ছিল অদম্য। ড. কামাল হোসেন আর ড. রেহমান সোবহান বাংলা লেখেন না বলে তিনি অনুযোগ করতেন। সেইসঙ্গে মুসা এও জানিয়েছেন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সচরাচর কথাবার্তায় বাংলা প্রমিত চলিত ভাষা ব্যবহার করতেন না। তিনি ঢাকাকেন্দ্রিক মৌখিক ভাষায় কথা বলতেন। …রাজ্জাক স্যারের নিজের একটি কথ্যরীতি ছিল, যা কি না আঞ্চলিক বলে অনেকেই ভুল করতেন। তার কথা নিজের স্টাইল ছাড়া আর কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে আহমদ ছফাও বলেছিলেন, ঢাকাইয়া বুলি তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন, তার মুখে শুনলে এ ভাষাটি ভদ্রলোকের ভাষা মনে হয়। (যদ্যপি আমার গুরু)
আবদুর রাজ্জাক বলেন, আইজকার ইন্ডিয়ার এডুকেটেড মানুষেরা যে ভাষায় পরস্পরের লগে কম্যুনিকেট করেন, হেইডা কোনো ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ না। তারা ইংরেজির মাধ্যমেই পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেন। ব্রিটিশের চইল্যা যাইবার পঞ্চাশ বছর পরেও যারা একটা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তৈয়ার করতে পারে নাই, তারা এক লগে থাকবো কী কইরা আমি তো চিন্তা করবার পারি না।
এমন মাটির খাঁটি মানুষ নিয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক আহরার আহমদ (আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক) বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তার প্রাণ, তার ভালোবাসা, তার আস্থা। তিনি আমাদের চিন্তা করতে শিখিয়েছিলেন। ক্ষমতার লোভ, স্বীকৃতির লোভ- সবকিছু থেকে তিনি নির্মোহ ছিলেন। কোনো ভান-ভণিতা বা মুখোশ তার ছিল না।
এর প্রমাণ মিলবে ব্যাতিক্রমভাবে। আবদুর রাজ্জাক শুধু জ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন না, অনেক ছাত্রী, এমনকি অনেক ছাত্রের বউয়ের রান্নার শিক্ষকও ছিলেন। রান্না করার বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল তার। বাজার করতেন বেশ সময় নিয়ে। প্রায়ই তিনি বলতেন, আমি যেকোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিস দেখি। এক কাঁচাবাজার, অন্যটা হলো বইয়ের দোকান। আমার মনে হয়, কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক। যে দেশে বইয়ের দোকান নাই সে দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। কাঁচাবাজার দেখলেই বোঝা যায়, দেশের অবস্থা কেমন। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয়, তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়। একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম। সেখানে বইয়ের দোকানে শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই কম্যুনিজম সম্পর্কে, শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই ইসলাম সম্পর্কে। সুতরাং সেই দেশে যে টেনশন থাকবে তা বোঝার জন্য হাফেজ হওয়ার দরকার নাই।
জ্ঞানতাপসের প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম খ্যাতিমান গবেষক সরদার ফজলুল করিম তাকে ‘দ্বিতীয় পিতা’ হিসেবে গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতেন। পুত্রের সে দায় খানিকটা হলেও তিনি শোধ করতে চেয়েছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ’ গ্রন্থটির মধ্যে দিয়ে। গবেষক সৌভিক রেজা বলেন, সরদার ফজলুল করিমের উদ্যম আর পরিশ্রমের কারণে অন্যভাবে খানিকটা হলেও রাজ্জাক স্যারকে পেয়েছিলাম। এ ছাড়া, সরদার ফজলুল করিমের নানারকম লেখালেখির ভেতরও রাজ্জাক স্যারের প্রসঙ্গ কতোভাবেই না পাই! সে কারণেই হয়তো সরদার ফজলুল করিমকে ছাড়া রাজ্জাক স্যারের কথা চিন্তা করতে পারি না, রাজ্জাক স্যারের কথা উঠলেই সরদার ফজলুল করিমকে মনে না করে থাকা কষ্টকর।
রাজ্জাক স্যারের সেই আলাপচারিতাকে এক ‘স্বতঃস্ফূর্ত স্মৃতিকথা’ হিসেবে উল্লেখ করে সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, অধ্যাপক রাজ্জাকের এ স্মৃতিকথা… একান্ত ব্যক্তিগত সংগ্রহে না রেখে তাকে অপর দশ জন পাঠক এবং সমাজবিদের সামনে পেশ করার চেষ্টা করেছি। কেন করেছেন তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সরদার স্যার লিখেছেন, চেষ্টা করেছি এই চেতনা থেকে যে, একজন ব্যক্তির জীবন তার কালের সমগ্র ইতিহাস না হলেও, সে জীবন সেই কালের দেশ-সমাজ ও মানুষের উপাদান। অনেকটা প্রায় একই কারণে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে শ্রদ্ধেয় আহমদ ছফা তার স্মৃতিকথা লেখেন ‘যদ্যপি আমার গুরু’। আবদুর রাজ্জাক ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, আর ছফা উনার সান্নিধ্যে আসেন ১৯৭০ সালের দিকে। আহমদ ছফা ১৯৭০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত সময়টাকে বাঁধার চেষ্টা করেছেন এই বইয়ে।
আর দুটি বই ঠিক এক মাপের নয়। নয় যে সেটা আহমদ ছফাও জানতেন। সে কারণেই ফজলুল করিমের বইটিকে তিনি ‘অসাধারণ গ্রন্থ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ভোলেননি। এটা নিছক আহমদ ছফার বিনয় নয়। রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে তার স্মৃতিকথা প্রকাশের কারণ হিসেবে ছফা জানিয়েছিলেন, আমার শিক্ষক অধ্যাপক রাজ্জাকের অনন্য ব্যক্তিত্বের মহিমা আমি যেভাবে অনুভব করেছি, অন্তত তার কিছুটা উত্তাপ দশ জনের কাছে প্রকাশ করি। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি তুলনায় একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের বাস্তব অসমর্থতার এমন চিন্তার নিদর্শন দেখা যায় না। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সাধনা ছিল নিজেকে প্রতিনিয়ত যোগ্য করে তোলা? যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে অবজ্ঞা বা নিঃস্পৃহতা-মিশ্রিত শ্রদ্ধা পেতে না হয়? (সৌভিক রেজা: একটি প্রজ্ঞাশাসিত সংকলন)
জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক স্যারের আমাদের অভিভাবক। রাষ্ট্রের সংকট সম্ভাবনায় মতামত দিয়ে সমাজকে এগিয়ে দিয়েছেন। আমার পঠন পাঠন থেকে বলতে পারি- পূর্ববাংলার সমাজব্যবস্থা নানাভাবে পশ্চাৎপদ যখন ছিল, সেই সময় পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নিতে অন্যতম ছিলেন জ্ঞানতাপস। তিনি তার চিন্তায় সমাজের কল্যাণে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। বিশেষত সাহিত্য সংস্কৃতি শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেছিলেন। তার চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক। গবেষক জাহিদুর রহিমের সাহায্যে বলি, বাঙালি মুসলমান সমাজকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার পেছনে অধ্যাপক রাজ্জাকের ভূমিকার সঙ্গে এই বঙ্গের আর কারও তুলনা হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন হয়েছিল, যা মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না এবং এই আন্দোলনের কুশীলবদের অনেকেই রাজ্জাক স্যারের চাইতে বয়সে বড় ছিলেন, এমনকি ছিলেন শিক্ষক স্থানীয়। কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিদের একজন। আরও ছিলেন কাজী ইমদাদুল হক, আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, আবুল ফজল প্রমুখ। রাজ্জাক স্যার কাজী সাহেবের গুণমুগ্ধ এবং স্নেহভাজন ছিলেন। কিন্তু সেই বুদ্ধি মুক্তির আন্দোলনের মর্মাবেগ তাকে স্পর্শ করেছিল, এমন মনে হয় না। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সভ্যরা ব্রাহ্মসমাজের আদলে বাঙালি মুসলমান সমাজের চিন্তাভাবনা রূপায়িত করার চেষ্টা করতেন। অন্তত ব্রাহ্মসমাজের আদল তাদের অনেকেরই মনে ক্রিয়াশীল ছিল, সেই জিনিসটি রাজ্জাক স্যারকে টানেনি।
প্রসঙ্গত, আহমদ ছফাকে এক জায়গায় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, একটা কোটেশন আপনে লেইখ্যা রাখেন, সুযোগমতো ব্যবহার করবার পারবেন। দেয়ার আর পিরিয়ডস ইন দ্য হিস্টোরি হোয়েন ক্রলিং ইজ দ্য বেস্ট মিন্স অব কম্যুনিকেশন। এই হামাগুড়ি দেওনের পাল্লায় ইন্টেলেকচুয়ালরা সকলের আগে থাকে।
তাকে দেখা বিদগ্ধ পাঠকমাত্র জানেন আলাপ আলোচনায় রাজ্জাক স্যার ছিলেন প্রকৃতির মতো, বলেছিলেন বদরুদ্দীন উমর তার স্মরণসভায়। কেননা প্রকৃতিতে ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বন্যা, ভূমিকম্প যেমন ভালো-মন্দ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই পক্ষপাতহীন, তেমনি তিনি নিজের স্নেহ পক্ষপাতহীনভাবে তার চারপাশের সকলের ওপর বর্ষণ করতেন। তার কাছে কেউ যা কিছু- সে যাই হোক- চাইতেন, তিনি সাধ্যমত পূরণ করতেন। তার সংস্পর্শে যারাই এসেছেন ও তার স্নেহ লাভ করেছেন, তাদের সকলের কাছেই তিনি অবিস্মরণীয়। (আবদুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ)
তার কোনো বাছ-বিচার ছিল না, তিনি সাজ্জাদ হোসেনরে ভালোবাসতেন- মুনীর চৌধুরী, রবি গুহ ও সরদার ফজলুল করিমকেও ভালোবাসতেন। ...আনিস বলেছে, রাজ্জাক স্যারের স্নেহ সূর্যের মতো, সবখানেই পড়ে। যেখানে পড়া উচিত সেখানে পড়ে, যেখানে পড়া উচিত নয়, সেখানেও পড়ে। তার চরিত্রের মেইন দিক হচ্ছে, জ্ঞান তার কাছে খুব প্রিয় ছিল। জ্ঞানীকে নানানভাবে সমাদর করতেন। তার জীবনে আর কোনো কাজ ছিল না। তিনি এসব নিয়েই থাকতেন। এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন সরদার ফজলুল করিম।
আমি সবচেয়ে অবাক হই- আবদুর রাজ্জাক প্রচলিত যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে পরতেন। ভাবনা উসকে দেওয়ার ক্ষমতা ও যোগ্যতা ছিল অসামান্য। আবদুর রাজ্জাকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ১৯৫০ সালের দশকের শেষ কি ১৯৬০ সালের দশকের শুরু ঠিক নেই। আনিসুজ্জামান তখন মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন। কোনো এক সেমিনারে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে লিখেছেন একটা ইংরেজি প্রবন্ধ। ‘রাশভারী’ ওই প্রবন্ধের শিরোনামটি বাংলায় তর্জমা করলে তা এরকম দাঁড়ায় ‘উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার উপকরণ’।
মজলিশে যারা হাজির ছিলেন তাদের মধ্যে প্রবীণ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একজন। অনেক সাধাসাধির পর তিনি কয়েকটি প্রশ্ন রাখলেন। আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন প্রশ্নগুলো ছিল- বাংলাদেশ (বেঙ্গল) কোথায়? উনবিংশ শতাব্দী (নাইনটিনথ সেঞ্চুরি) কখন? এবং বাংলাদেশের মুসলমান (মুস্লিমস অব বেঙ্গল) কারা? অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সঙ্গে যোগ করলেন, এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর পেলে বাকি কথা আলোচনা করা যাবে। আনিসুজ্জামানের মন্তব্য, এরপর পুরো সভা পণ্ড হওয়ার অবস্থা।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক খুশবন্ত সিং ১৯৭৪ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের ওপর একটি ফিচার লিখেছিলেন। পরে অবশ্য তা ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ায় পুনঃমুদ্রিত হয়। যেহেতু প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক কিছুই লিখে রেখে যাননি, তাই তার সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তা হচ্ছে লোকমুখে, সাক্ষাৎকারে এবং কৃতী সন্তানের উৎসর্গপত্র কিংবা স্মৃতিকথামূলক বইতে। আহমদ ছফা রচিত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ এই বইটি থেকেই মূলত তার জীবনযাপনের বেশ খানিকটা ধারণা ও ছায়া পাওয়া যায়।
তবে হুমায়ুন আজাদ সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করেন, আপনি কোনো বই লিখলেন না কেন? তখন তিনি জানিয়েছেন, আলস্যবশত। হয়তো বা জেনেছি, তাও খুবই অকিঞ্চিৎকর। তবে এটা প্রতারণাও হতে পারে।
লিখেন আর নাই লিখেন- যেকোনো মনীষীর চিন্তা ও আদর্শ রেখে যাওয়াই মূলকথা। এমনি ভাবনায় তার চর্চা হয়ে যাচ্ছে। আরও প্রয়োজন- কারণ যেকোনো বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক একটা উচ্চমান ধারণ করতেন আবদুর রাজ্জাক। প্রায় দুই দশক তিনি নেই শারীরিকভাবে। বাংলাদেশেও মূল্যবোধের অবক্ষয় ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। এখন তাকে স্মরণ করে আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের হাত ধরে দেশের মাটি মানুষের সম্ভাবনাকে কাজে লাগালে রাষ্ট্র নিজেই উপকৃত হবে, না হয় আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র-সমাজ।
লেখক: ইমরান মাহফুজ, কবি, গবেষক
Comments