কষ্টের শেষ নেই তিস্তা পাড়ের বীরাঙ্গনা জহিরনের

তিস্তা পাড়ের বীরাঙ্গনা জহিরন বেওয়া। ছবি: স্টার

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক পৈশাচিক ঘটনা বলতে চাইতেন না তিস্তা পাড়ের বীরাঙ্গনা জহিরন বেওয়া। কেউ জানতে চাইলে তিনি শাড়ির আঁচলে মুখ লুকায় রাখতেন। জীবনের শেষ সময় এসে এসব ঘটনা বর্ণনা করতে আর মুখ লুকাচ্ছেন না তিনি। নিজের আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করছেন সেসময় তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুঃসহ ঘটনাবলি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা নদীর কোল ঘেঁষে তিস্তা পাঙ্গাটারী গ্রামটি তিস্তা রেল সেতু থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রেল সেতুর পাশে গড়েছিল ক্যাম্প। এখান থেকে বিভিন্ন স্থানে হামলা পরিচালনা করেছিল। নারীদের ধরে নিয়ে এসে এই ক্যাম্পে আটকে রেখে তারা চালাত অমানবিক ও পৈশাচিক নির্যাতন। তাদের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকারদের মধ্যে একজন জহিরন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২৫ বছর বয়সী দুই সন্তানের জননী ছিলেন জহিরন বেওয়া। বড় মেয়ে আছিয়া বেগমের বয়স ছিল দশ বছর আর ছেলে নানকু মিয়ার বয়স ছিল দুই বছর। তারিখ ও মাসের নাম মনে নেই জহিরনের। তবে সেদিন ছিল শনিবার দুপুর। তার স্বামী কাজীম উল্ল্যাহ পাট কেনা-বেচার কাজে বাড়ির বাইরে ছিলেন। মেয়ে আছিয়া বেগম ছিল নানার বাড়িতে। জহিরন ঘরে বসে তার দুই বছরের শিশু নানকুকে খাওয়াচ্ছিলেন। গ্রামে হানাদার বাহিনী প্রবেশ করেছে বলে মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন। ঘরে স্বামী নেই, মেয়ে নেই, তাই জহিরন দুধের শিশুকে নিয়ে ঘরের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন। জহিরন ধরা পড়ে যায়। দুধের শিশুটিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর তিন সদস্য মিলে জহিরনের সঙ্গে অমানবিক পৈশাচিক নির্যাতন করে। সেখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। জহিরনকে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। তিস্তা রেল সেতুর পাশে পাকিস্তানি ক্যাম্পে জহিরনকে তিন দিন আটকে রেখে পৈশাচিক নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা।

পরবর্তীতে জীবন নিয়ে জহিরন বাড়িতে ফিরে আসলেও হারিয়ে যায় তার মুখের হাসি, মলিন হয়ে যায় তার মুখশ্রী। কারো সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলেন না। একাকী থাকেন আর নীরবে কাঁদেন।

জহিরন বেওয়া জানান, তার স্বামী প্রথমে তাকে মেনে নিতে না চাইলেও কয়েকদিন পর মেনে নেন। কিন্তু স্বামীর সংসারে মন বসাতে পারছিলেন না তিনি। এ ঘটনার পর থেকে কোনদিনই স্বামীর সামনে মাথা উঁচু করে থাকতে পারেননি। স্বামীর সকল অন্যায়-অত্যাচার মেনে নিতে হয়েছে।

‘মুই কোনোদিনই ওইল্যা কথা ভুইলবার পাং না। মোর চোখ দুইটা বন্ধ করলে ওইল্যা দ্যাখবার পাং এ্যালাং,’ বলছিলেন জহিরন বেওয়া। ‘আগোত তো এইল্যা কথা কাকো কং নাই। কাইও পুষ কইল্যে মুই ওটে থাকি চলি গ্যাইছোং। মোর মরণের সময় হইছে তাই এ্যালা আর শরম করি লাভ কি,’ বললেন তিনি।

স্বাধীনতার পর আরও দুই সন্তানের জন্ম দেন জহিরন। স্বামী কাজীম উল্ল্যাহ ২০ বছর আগে মারা গেছেন। সন্তানরা সবাই আলাদা আলাদা সংসারে থাকেন। স্বামীর মৃত্যুর পর জহিরনের জীবন চলছে সরকারি বয়স্ক ভাতা আর অন্যের বাড়িতে কাজের মজুরী দিয়ে।

‘মোর দুঃখের শ্যাষ নাই। যুদ্ধের আগোত মোর সুখ আছিল। যুদ্ধের সময় ওই শয়তানগুলা মোর কপালোত দুঃখ ঠেলি দিছে এই দুঃখ এ্যালাং আছে। এ্যালা মোর মরণ হইলে বাছোং,’ এভাবেই নিজের দুঃখের অনুভূতি জানিয়ে সরকারের কাছে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির দাবি জানান জহিরন বেওয়া।

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

5h ago