‘অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন পেতে কমপক্ষে আরও ২-৩ মাস সময় লাগবে’

ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য। তবে, ট্রান্সপোর্টেশন ও কোল্ড চেইন ইস্যুর কারণে সেই ভ্যাকসিন বাংলাদেশ সংগ্রহ করছে না। বাংলাদেশ প্রথমেই সংগ্রহ করবে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার উৎপাদিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন।
ছবি: সংগৃহীত

ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য। তবে, ট্রান্সপোর্টেশন ও কোল্ড চেইন ইস্যুর কারণে সেই ভ্যাকসিন বাংলাদেশ সংগ্রহ করছে না। বাংলাদেশ প্রথমেই সংগ্রহ করবে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার উৎপাদিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন।

অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক, অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব ও অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। (বাম দিকে থেকে)

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল এখনো চলছে। যা শেষ হতে আরও দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে বলে ধারণা করছেন যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা। সবমিলিয়ে কবে নাগাদ আমরা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন পেতে পারি?— এ বিষয়ে তিন জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘প্রথম কথা হলো, যেকোনো অগ্রগতিতেই আমাদের চিন্তা করতে হবে যে, এই ধরনের অগ্রগতির ভিত্তিতে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তখনই, যখন কোনো একটা ভ্যাকসিন লাইসেন্সিং অথরিটির, অর্থাৎ মার্কেটিংয়ের জন্য অনুমোদন পাবে। সেই পর্যায়ে আসতে এখনো যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন আছে। এখনো কোন ভ্যাকসিন কবে ডব্লিউএইচও ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) অনুমোদন পাবে, সেটা কেউ জানে না। মানসম্পন্ন, কার্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন ভ্যাকসিন আসবে কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন।’

‘একটা ভ্যাকসিন ৩০ বছর বয়সী কারো জন্য কার্যকর হলেও বেশি বয়সী কারো জন্য কার্যকর নাও হতে পারে। বয়স্কদের অন্যান্য রোগ বিবেচনায় সেটা কতটা কম ঝুঁকিপূর্ণ, সেটাও একটা বিষয়। এসব নিয়ে তো গবেষণা হচ্ছে এবং আরও হবে। আমার কাছে যতটুকু তথ্য আছে, সেই অনুযায়ী, ভ্যাকসিনের যে কার্যকারিতার কথা বলা হচ্ছে, সেটা যেমন প্রমাণসাপেক্ষ; আবার এটাও প্রমাণসাপেক্ষ যে, কবে নাগাদ ভ্যাকসিন মার্কেটিংয়ের জন্য আসতে পারে, তা কেউ বলতে পারে না। সুতরাং আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। যতগুলো গবেষণা হচ্ছে, ডব্লিউএইচওর কমিটি সেগুলো বিশ্লেষণ করে থাকে। বিশ্লেষণ করে তারা সেটার ওপর সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর একটি কমিটি আছে। যারা ভ্যাকসিন তৈরি করছে, তারাই তাদের আপডেট ডব্লিউএইচওকে জানাবে। এখানে এক্সটারনাল প্যানেল অব এক্সপার্ট (এসএজিই) আছে, তারাই ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ফলাফলগুলো বিশ্লেষণ করবে। তারপর সংশ্লিষ্ট দেশ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এরপর ডব্লিউএইচও রিকমেন্ড করবে। কাজেই আমাদেরকে অনিশ্চয়তার মধ্যে আশা নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। তবে, খুব বেশি আশাবাদী হওয়াটা ঠিক হবে না।’

ফাইজারের ভ্যাকসিন যুক্তরাজ্য শুধু তাদের দেশে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বলে উল্লেখ করে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘প্রত্যেক দেশেরই একটা স্থানীয় লিগ্যাল অথরিটি থাকে। তারা যদি চায়, যেকোনো ভ্যাকসিনই তারা তাদের সেখানে ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে। যেমন: বাংলাদেশের অথরিটি যদি চায়, তারা তাদের প্রক্রিয়া অনুসারে ফাইজার বা মর্ডানা কিংবা যেকোনো ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে। এখন বিষয়টা হচ্ছে ফাইজারের ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়। সেটা সংরক্ষণ করার মতো ফ্যাসিলিটি ও জ্ঞানটা কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের নেই। কারণ এটার চর্চা আমরা বাংলাদেশে করিনি। যে ভ্যাকসিনগুলো আমরা বাংলাদেশে দেই এবং সংরক্ষণ করি, সেগুলো সাধারণত দুই থেকে আট ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অথবা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখি। আর ফাইজারের ভ্যাকসিনটা আলট্রা কোল্ড চেইনে রাখতে হবে। সেটা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে মাত্র পাঁচ দিন সংরক্ষণ করা যাবে। আবার মডার্নার ভ্যাকসিনটা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে এক মাস সংরক্ষণ করা যাবে। এই দুটো ভ্যাকসিনই জেনেটিক ভ্যাকসিন।’

‘ভ্যাকসিন তো প্রথমে ল্যাবরেটরিতে রাখতে হবে। এরপর সেখান থেকে ট্রান্সপোর্ট করতে হবে। তারপর সেটাকে স্টোর করতে হবে। এরপর হ্যান্ডলিং ও ডিস্ট্রিবিউশন। এই পর্যায়ে এসে ট্রান্সপোর্টেশনের বিষয় যেমন আছে, আবার সংরক্ষণের প্রশ্নও আছে। এখন আমরা যদি ওইসব ভ্যাকসিন নিতে চাই, তাহলে বাংলাদেশে বিদ্যমান পুওর কোল্ড চেইনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যেটা খুব ব্যয় ও সময় সাপেক্ষ। আমাদের সরকার এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে আছে। কোটি কোটি ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সরকারের নেই। সেই পরিমাণ মানব শক্তি ও সংরক্ষণ সক্ষমতাও আমাদের নেই’, বলেন অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘ডব্লিউএইচও ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার আগ পর্যন্ত তো সরকার ভ্যাকসিন নেবে না। কাজেই ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচও ও সংশ্লিষ্ট দেশের ক্লিয়ারেন্সটা প্রয়োজন। এখনো অক্সফোর্ড সেই ক্লিয়ারেন্স পায়নি। এখন ভ্যাকসিন নিয়ে বিভিন্ন রকমের কথা রয়েছে। এখন আসলেই কবে ভ্যাকসিনটা পাওয়া যাবে, সেটা বলা খুব কঠিন। এখন ফাইজারের ভ্যাকসিনটা ইতোমধ্যে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু, সেটা সংরক্ষণের কোল্ড চেইন সক্ষমতা তো আমাদের নেই। এরপরেও তারা যেটা করছে, ফাইজারের ভ্যাকসিনগুলো ছোট ছোট প্যাকেটে করে ড্রাই আইসে করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু, আমাদের সরকারি পর্যায়ে সেটা আনার কোনো সম্ভাবনা নেই। বেসরকারি পর্যায়ে কী আছে, সেটা আমি জানি না। সুতরাং ভ্যাকসিন আমরা কবে পাব, সেটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। যদিও আমরা বলছি শিগগিরই পাব, কিন্তু, সেই শিগগিরটা কবে, তা বলা যাচ্ছে না।’

‘আবার ভ্যাকসিন আসার পরেও অনেক বিষয় আছে। সেটা আনতে তো অর্থের প্রয়োজন আছেই, সেটা আনার পর ঠিক মতো কাজ করবে কি না, টেকনিক্যালি কোনো সমস্যা হবে কি না, এসব তো রয়েছে। সুতরাং এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন নিয়ে যতটুকু জানা গেছে, তাতে বলা যায় যে, বৈশ্বিকভাবেও নির্দিষ্ট করে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে, আমাদের জন্য অক্সফোর্ডেরটা তুলনামূলকভাবে পাওয়াটা সহজলভ্য। আরও অনেক ভ্যাকসিনই তো তৈরি হচ্ছে। ভারতও তৈরি করছে। সবমিলিয়ে আমরা কবে পাব, তা বলা যাচ্ছে না। যদিও সরকার অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের বিষয়ে ইতোমধ্যে একটা সমঝোতা করে রেখেছে। কিন্তু, অন্য কোথাও তো আর চেষ্টা করছে না। বলা হচ্ছে, আমাদের টাকা আছে। কিন্তু, টাকা থাকলেই পাওয়া যাবে, বিষয়টি তো এমন না। অক্সফোর্ডেরটা ছাড়া তো অন্যগুলোতে আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি না। যদিও ফেব্রুয়ারি নাগাদ ভ্যাকসিন আসবে বলে দাবি করা হচ্ছে, কিন্তু, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না’, বলেন তিনি।

সবশেষে অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘ভ্যাকসিন আসার আগে তো বটেই, এটি আসার পরেও সর্বোপরি স্বাস্থ্যবিধির ওপর আমাদের জোর দিতে হবে। এটা তো আমাদের হাতেই আছে। এর কোনো বিকল্প নেই।’

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘আমরা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটা পাচ্ছি। এ ছাড়াও, যাদের ভ্যাকসিন সংরক্ষণের তাপমাত্রা দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে, চাইলে তাদেরটাও আমরা নিতে পারি। মানে রাশিয়ান ও চাইনিজ যেগুলো। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিয়ে যে প্রশ্নটা এখন উঠেছে, সেটা হচ্ছে এটির কার্যকারিতা। তাদের ভ্যাকসিনের যে ফল জানানো হয়েছে, সেখানে কিছু বিষয় রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিনটির দুটো ফুল ডোজ যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা ৬২ শতাংশ। আবার ভুলবশত যাদেরকে প্রথমে হাফ ডোজ ও পরে ফুল ডোজ দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা পাওয়া গেছে ৯০ শতাংশ। পরে দুটোকে মিলিয়ে গড়ে ৭০ দশমিক ৪ শতাংশ কার্যকারিতার কথা বলা হয়েছে। এখন তারা ট্রায়াল দিচ্ছে দুটো ফুল ডোজ এবং একটি হাফ ডোজ ও একটি ফুল ডোজ প্রয়োগ করে। এটা করতে অবশ্যই তাদের সময় লাগবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে শুধু আমাদের নয়, অন্যান্য দেশগুলোতেও ভ্যাকসিন আসতে সময় লাগবে। এটা সময় সাপেক্ষ বিষয়। সবমিলিয়ে আমরা কবে নাগাদ ভ্যাকসিনটি পাব, তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। যারা দেবে, তারাও কিন্তু নিশ্চিত না যে তারা কবে নাগাদ দিতে পারবে। গত ৫ নভেম্বর যখন ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হলো, সেদিনও জানতে চাওয়া হয়েছিল যে কবে নাগাদ তারা ভ্যাকসিন দিতে পারবে। তখন তারাও কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি যে কবে নাগাদ ভ্যাকসিনটি দিতে পারবে।’

‘ফলে কবে নাগাদ ভ্যাকসিনটি পাওয়া যাবে, এখানে একটু অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্তত আরও দুই থেকে আড়াই মাস তো অপেক্ষা করতেই হবে। আমি মনে করি, নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল যে কবে নাগাদ এটা পাওয়া যাবে’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago