ভ্যাকসিন কবে পাব এবং অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ‘ভুল ডোজ’র আশাবাদ
সঠিক ডোজের কার্যকারিতা ৬২ শতাংশ। আর ভুল ডোজের কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ। ফলে ভুল ডোজ এখন ‘লাকি ডোজ’!
ঘটনাটি ঘটেছে অক্সফোর্ড এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগ করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের ক্ষেত্রে। যদিও মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ক্ষেত্রে ভুলের সুযোগ নেই বলে মনে করেন ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম। ড. আকরাম বর্তমানে ব্রিটেনের দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের জ্যেষ্ঠ গবেষক হিসেবে কর্মরত।
বায়ো মেডিকেল সাইন্স গবেষক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী গত বৃহস্পতিবার টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘এক ডোজ স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকসিনে ৫০ বিলিয়ন ভাইরাস থাকে। ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং এই ভ্যাকসিনে ভাইরাসের সংখ্যা পরিমাপ করতে গিয়েই ভুলের বিষয়টি ধরা পড়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিজ্ঞানীরা নয়, ভুল ধরেছেন অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা। তারা দেখতে পেয়েছেন, প্রতি ডোজে যেখানে থাকার কথা গড়ে ৫০ বিলিয়ন ভাইরাস, সেখানে রয়েছে ২৫ বিলিয়ন ভাইরাস। মানুষের শরীরে ওষুধ বা ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ক্ষেত্রে ভুল করার কোনো অবকাশ নেই। এখানে বাঁচা-মরার প্রশ্ন। অ্যাস্ট্রাজেনেকা যে ভুল করেছে তা কোনো বিবেচনাতেই করার সুযোগ নেই। এর জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার জবাবদিহি করা উচিত। ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমএইচআরএ থেকে অনুমতি নিয়েছিল পূর্ণ ডোজ করে ব্যবহারের। অর্ধেক ডোজ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ ভুলবশত, যা অনুমোদনের শর্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল অত্যন্ত সন্তোষজনক ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সমস্যাটা হয়েছে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে। তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছিল ব্রিটেন, ব্রাজিল, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকায়। তৃতীয় ধাপের ফলাফল পর্যালোচনা করেছে ব্রিটেন এবং ব্রাজিলের ট্রায়ালের ডেটার ওপর ভিত্তি করে। এই ট্রায়ালে ভলান্টিয়ারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ হাজার। প্রথমদিন এক ডোজ এবং ২৮ দিন পর আরেক ডোজ দেওয়ার কথা। কিন্তু কিছু ভলান্টিয়ারকে প্রথম ডোজ দেওয়ার পরে তারা বুঝতে পারেন কোথাও ভুল হয়েছে। তারা লক্ষ্য করেন ব্রিটেনের ২,৭৪১ জন ভলান্টিয়ারকে প্রথমে পূর্ণ এক ডোজের পরিবর্তে অর্ধেক ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। তারা সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়টি এমএইচআরএ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বিষয়টি জানায়। এমএইচআরএ তখন দ্বিতীয় ডোজটি পূর্ণ ডোজে (Full dose) ট্রায়াল অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেয়। তার মানে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে ২,৭৪১ জনকে দেওয়া হয়েছে দেড় ডোজ ভ্যাকসিন এবং অন্য প্রায় নয় হাজার জনকে দেওয়া হয়েছে দুই ডোজ। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেল, পূর্ণ দুই ডোজ প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা ৬২ শতাংশ। আর দেড় ডোজ প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ। এ কারণেই ভুল ডোজকে বলা হচ্ছে “লাকি ডোজ”।’
‘লাকি ডোজ’র কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় দেখা দেওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে ড. আকরাম বলছিলেন, ‘২,৭৪১ জনের ক্ষেত্রে ডাইভারসিটি ছিল না। মানে এথনিক মাইনরিটি, কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান, আফ্রিকান ছিল না। যেখানে ডাইভারসিটি থাকার কথা ৩৩-৪০ শতাংশ। অন্যান্য ভ্যাকসিন যেমন ফাইজার বা মডার্নার ক্ষেত্রে যা আছে ৪০ শতাংশ। বয়সের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে ঠিক নেই। দেড় ডোজ প্রাপ্ত ভলান্টিয়ারদের বয়স ছিল ১৮-৫৫ বছর। বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের এই দেড় ডোজ প্রয়োগ করা হয়নি।’
‘এ কারণে এ ফলাফল থেকে বলা যায় না যে, বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এই ডোজ কার্যকর হবে। যেখানে ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাকসিন ৬০, ৭০ বা ৮০ বছর বয়স্কদের ক্ষেত্রেও কার্যকর। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ফুল ডোজে অর্থাৎ এক ডোজ এক ডোজ করে পূর্ণ দুই ডোজের ট্রায়াল হয়েছে ৮,৯০০ জনের ওপর। আর হাফ ডোজ ও ফুল ডোজ মানে দেড় ডোজে ট্রায়াল হয়েছে মাত্র ২,৭৪১ জনের ওপর। এত কম সংখ্যক ভলান্টিয়ারের ওপর চালানো এই হাফ ডোজ/ফুল ডোজের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিনটির অনুমোদন না পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।’
অক্সফোর্ডের এই ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল সম্পন্ন হওয়ার পর আবার সবকিছু নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
‘অ্যাস্ট্রাজেনেকার সিইও বলেছেন, তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল তারা আবার নতুন করে শুরু করবে। তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল যেসব দেশে চলছিল, সেখানে তারা নতুন করে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করবে। সিইও তার বক্তব্যে দেশের নাম উল্লেখ না করলেও বোঝা গেছে যে, আন্তর্জাতিকভাবে তারা ফ্রেশ ট্রায়াল শুরু করবে। হাফ ডোজ, ফুল ডোজের ট্রায়াল নতুন করে শুরু করলে কত সময় লাগবে বলা মুশকিল’, বলছিলেন এই ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিজ্ঞানী।
ড. আকরাম বলেন, ‘তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল তারা শুরু করেছিল গত ২৭ জুন। সেই হিসেবে শেষ করতে সময় লাগলো প্রায় সাড়ে চার মাস। সিইওর বক্তব্য থেকে বুঝতে পারছি নতুন করে শুরু করা ট্রায়ালে আগের চেয়ে সময় কম লাগবে। তারা নতুন করে হাফ ডোজ, ফুল ডোজ ট্রায়ালের অনুমতি নেবে এমএইচআরএ থেকে। নতুন করে শুরু করলে আমার ধারণা- দুই থেকে তিন মাসের মতো সময় লাগবে। কারণ হাফ ডোজ, ফুল ডোজের ২,৭৪১ জনের ট্রায়ালের ফল তাদের হাতে আছে। এখন সম্ভবত আরও আট হাজারের ওপর ট্রায়াল করবে। এখানে তারা ডাইভারসিটি ও বয়সের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করবে।’
ট্রায়াল জটিলতায় আটকে গেলেও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশি-ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানীর।
তিনি বলছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে ট্রায়াল হয়েছে এবং তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল সম্পন্ন হলে, আমার ধারণা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সন্তোষজনকই পাওয়া যাবে। ফাইজার বা মডার্নার মতো কার্যকারিতা যদি ৯০-৯৫ শতাংশের ওপরে নাও হয়, ৮০-৮৫ শতাংশ কার্যকর হবে বলে মনে করছি। যদি এমন ফল পাওয়া যায় তবে ভাবার কারণ নেই যে, ফাইজারের ভ্যাকসিনের চেয়ে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন খারাপ। ৫০ শতাংশ কার্যকর হলেই এফডিএ, সিডিসি সেই ভ্যাকসিনকে কার্যকর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যেমন: প্রতিষ্ঠিত ফ্লু ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কিন্তু ৫০-৬০ শতাংশ, যা নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে।’
ব্রিটেনের এমএইচআরএ অনেকটা এফডিএ’র কাউন্টার পার্ট হিসেবে পরিচিত। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের যে ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে, সেটি এমএউচআরএ এখন পর্যালোচনা করছে। অনুমতি দেবে কি না, তা হয়তো আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে জানা যাবে।
ড. আকরামের পর্যালোচনা, ‘অনুমতি দেবে কি না জানি না। যদি ধরে নেই অনুমতি দেবে, তবে সেটি দেবে শুধু ব্রিটেনের জন্য। ভারত, ব্রাজিল বা অন্য দেশের জন্য নয়। ভারত বা ব্রাজিল অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করছে, উৎপাদন করবে। কিন্তু তারা অনুমোদন দিতে পারবে না। তারা তখনই অনুমোদন পাবে, যখন ডব্লিউএইচও অনুমোদন দেবে। ট্রায়ালের বর্তমান ফলাফলকে ডব্লিউএইচও ও এফডিএ সন্তোষজনক মনে করছে না। তারা ইতোমধ্যে সেই ইঙ্গিত দিয়েছে।’
‘ভারতে সেরাম যে ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে, ডব্লিউএইচও অনুমোদন না দিলে ভারত নিজ দেশে বা অন্য কোথাও তা বিপণন করতে পারবে না। তার মানে বাংলাদেশও ভ্যাকসিন পাবে না, পেতে দেরি হবে। ডব্লিউএইচও আবার আস্থা রাখে এফডিএ’র ওপর। এফডিএ অনুমোদন দিলে ডব্লিউএইচও সাধারণত অনুমোদন দিয়ে দেয়।’
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের আগেই ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করেছে। এ বিষয়ে ড. আকরাম বলছিলেন, ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে বাজারে নিয়ে আসা যায়, সে কারণে অনুমোদনের আগেই অনেকে ভ্যাকসিন উৎপাদন করে মজুদ করেছে। অনুমোদন না পেলে ভ্যাকসিন ধ্বংস করে ফেলবে। ভারতে সেরাম যেমন কাগজপত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। কারণ তারা নিশ্চিত ছিল যে, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। কিন্তু ট্রায়ালের ভুল ও নতুন ট্রায়ালের বিষয়টি সামনে আসায় সবকিছুই অনিশ্চিত হয়ে গেছে।’
‘এমএইচআরএ’র অনুমোদন মানে শুধু ইউকেতে অনুমোদন, ইউরোপেও নয়। ফাইজারের ৮ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন ইউকে দু-একদিনের মধ্যে পেয়ে যাবে। আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝিতে ভ্যাকসিনেশন শুরু করতে পারবে। সমস্যা হচ্ছে ফাইজারের ভ্যাকসিন মাইনাস ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা শুধু ইউকের বড় বড় হাসপাতালে আছে। সারাদেশে যে সেবা কেন্দ্রগুলো থেকে মানুষ চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকে, সেসব জায়গায় মাইনাস ৮০ ডিগ্রিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এই ব্যবস্থা ইউরোপের কোনো দেশেই সর্বত্র নেই’, বলছিলেন ড. আকরাম।
ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ছাড়াও আলোচনায় আছে রাশিয়ার একটি ও চীনের দুটি ভ্যাকসিন। রাশিয়া ও চীনের ভ্যাকসিন বিষয়ে ড. আকরামের পর্যালোচনা, ‘তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল ছাড়া ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়া যায় না। রাশিয়া তার ভ্যাকসিন তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল সম্পন্ন না করেই অনুমোদন দিয়েছিল। এজন্য তারা সংবিধান পরিবর্তন করে নিয়েছে। নিজ দেশে প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাজারেও তার ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে চায়। সে কারণে ৪০ হাজার মানুষের ওপর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করেছে। এর মধ্যে ২০ হাজার মানুষের ওপর প্রয়োগ করা ফলে তারা দেখিয়েছে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৯২ শতাংশ। রাশিয়ার ভ্যাকসিন অনেকটা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের মতো। রাশিয়া ব্যবহার করেছে মানুষের অ্যাডিনো ভাইরাস আর অক্সফোর্ড ব্যবহার করেছে শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনো ভাইরাস।’
‘চীনও তার সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল না করেই নিজ দেশের জনগণকে দিতে শুরু করে। চীন তার আরেকটি ভ্যাকসিন ক্যানসিনোবায়ো তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল না করেই প্রয়োগ করেছে আর্মির ওপর। তবে, চীন সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করেছে। সিনোভ্যাকের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল বাংলাদেশে হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক, ব্রাজিলে তাদের ভ্যাকসিনটির তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে’, বলছিলেন ড. আকরাম।
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন তো আসবেই। তবে ইউকেতে ফাইজারের ভ্যাকসিন অনুমোদন পাওয়া ছাড়া, পৃথিবীর আর কোনো ভ্যাকসিন কোথাও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এখনো অনুমোদন পায়নি।’
Comments