একাত্তরের শহীদ স্মরণে

৭১ এর ডিসেম্বরে যশোরের কাছাকাছি পাক বাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদযাপন। ছবি: রেমন্ড ডেপার্ডন/ম্যাগনাম ফটোস

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানের মুখে পাকিস্তানি হানাদাররা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর অনেক জাতিগোষ্ঠী বছরের পর বছর রক্ত ঝরিয়েও পরাধীনতার জিঞ্জির ভাঙতে পারেনি। সেখানে মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে  শক্তিধর পাকিস্তানি বাহিনীকে হারিয়ে যেভাবে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার বীর সেনানীরা, তার তুলনা ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের আর একটি মাত্র উদাহরণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে, তাদের লেগেছিল দীর্ঘ সাত বছর। আর চূড়ান্ত ফয়সালা হয়েছিল প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে, যুদ্ধের ময়দানে নয়।

যুদ্ধের ময়দানে বাংলাদেশের এই অতুলনীয় সাফল্যের অন্তর্নিহিত কারণ কী ছিল? অনেকেই হয়তো ভারতের মতো একটি বৃহৎ প্রতিবেশীর সক্রিয় অংশগ্রহণকে বড় করে দেখাতে চাইবেন। কেউ কেউ তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের ভৌগলিক দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্য-সামন্ত ও রসদের যোগানে প্রতিকূল পরিবেশের কথা বলে থাকতে পারেন। তবে, একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন, এসবের কোনোটাই আসল কারণ নয়। বরং এদেশের আপামর জনতার সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা এ সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা ও সম্মোহনী ভাষণের মাধ্যমে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ও স্বাধিকারের দাবিতে এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ইস্পাত-কঠিন ঐক্য তৈরি করেছিলেন। ৭০’র নির্বাচনে এ জনপদ তার পক্ষে যে নিরঙ্কুশ গণরায় প্রদান করে, তা মেনে না নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন ২৫শে মার্চে তাকে উল্টো গ্রেপ্তার করে এবং নিরস্ত্র জনতার ওপর ক্র্যাকডাউন শুরু করে, তখনো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের জ্বালাময়ী ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য এবং প্রতিটি নির্দেশনা গণ-মানুষের কর্ণকুহরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

ফলে, দেশময় গণপ্রতিরোধ শুরু হয়, সাধারণ জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাকিস্তানের সশস্ত্র, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যরা সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করে এবং খুব দ্রুত এ যুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপ নেয়। অস্ত্র হাতে সবাই মাঠে না থাকলেও যুদ্ধের ময়দানে লড়াইরত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, পাক সেনাদের গতিবিধির তথ্য সরবরাহ করে এবং কায়মনোবাক্যে তাদের সাফল্য চেয়ে সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাত উঁচু করে এ জনপদের প্রতিটি মানুষ এ যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। পাক হানাদারেরা এখানেই মার খেয়ে যায়। একটি গণবিচ্ছিন্ন বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল জনতার সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু জাতিকে মুক্তির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, আর মুক্তিযুদ্ধ সে ঐক্যকে এক অনমনীয় ও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন যেসব অকুতোভয় তরুণ-যুবারা এক কাপড়ে মাঠে নেমে পড়েছিল, অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, কী ছিল তাদের চাওয়া-পাওয়া? অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি, পদ-পদবি? নিশ্চিতভাবে, এর কোনোটিই নয়।

একটি সম্পূর্ণরূপে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সামনে নিয়ে সেদিন যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, একমাত্র নিজ দেশ ও জাতির জন্য নিজেদের উৎসর্গ করা ছাড়া আর কিইবা অভীপ্সা থাকতে পারে তাদের? এই যে মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, উদগ্র বাসনা— এটাই কি সেদিন তাদের হাতে সাফল্যের জীয়নকাঠি হয়ে ধরা দেয়নি? মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনী যখন ডিসেম্বরে প্রত্যক্ষভাবে এ যুদ্ধে যোগ দেয়, তার আগেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নভেম্বরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। সুতরাং, ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণ চূড়ান্ত ফয়সালাকে নিঃসন্দেহে তরান্বিত করেছিল। কিন্তু, আসল কাজটা এ দেশের সন্তানরাই আঞ্জাম দিয়েছিল।

মুক্তিযোদ্ধারা এদেশের সূর্য সন্তান। উপরের আলোচনা থেকে আশা করি এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশমাতৃকার জন্যে নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষাই সেদিন তাদের অনুপ্রেরণার একমাত্র উৎস ছিল, কোনো বৈষয়িক চাওয়া-পাওয়া নয়। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও দোয়া করা ছাড়া এ আত্মদানের আদৌ কোনো প্রতিদান হতে পারে কি? নিশ্চয়ই নয়। সেদিন যেমন কোনো বৈষয়িক চাওয়া-পাওয়া নিয়ে তারা যুদ্ধে নামেননি, আজও তেমন কোনো আকাঙ্ক্ষা তাদের মনে কাজ করছে বলে ভাবলে এটা বড্ড অন্যায় হবে। বরং এটাই কি সঠিক নয় যে, আমরা বরং তাদের রক্ত-ঘামে অর্জিত এ দেশে তাদেরকে তাদের প্রয়োজন কিংবা যোগ্যতার নিরিখে কিছু সুযোগ-সুবিধা বা পদ-পদবি দিয়ে সম্মানিত করে আমাদের কাঁধে চেপে থাকা ঋণের ভার কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করতে পারি মাত্র?

বড্ড কষ্ট হয় যখন পত্র-পত্রিকায় দেখি, স্বাধীনতার ৪৯ বছরের মাথায়ও আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করতে পারিনি? মুক্তিযুদ্ধ তো কোনো গোপন বিষয় ছিল না! এ জাতির বলতে গেলে প্রতিটি মানুষ যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ যুদ্ধের অংশ ছিল, সেখানে কোনো একটি এলাকায় কে বা কারা অস্ত্র হাতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেটা তো এলাকায় সবার মুখে মুখে ফেরার কথা। সুতরাং, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

আর মুক্তিযোদ্ধাদেরই বা তাদের তালিকাভুক্ত করার জন্য আবেদন-নিবেদন করতে হবে কেন? আমরা যদি আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কিঞ্চিৎ সুযোগ-সুবিধা কিংবা ভাতা-পারিতোষিক দিয়ে তাদের সম্মানিত করতে চাই, তাদের খুঁজে বের করাটা আমাদেরই দায়িত্ব নয় কি? এটা কি একটা বড়ই আফসোসের বিষয় হবে না, যদি আপনি শোনেন যে, একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা বছর দশেক আগে উপযুক্ত দলিলাদি সমেত আবেদন করেও আজ পর্যন্ত তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত পাননি? এটা সঠিক যে, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে কিছু সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করায় সুযোগ-সন্ধানী কিছু লোক ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে তালিকাভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু, তাই বলে যাচাই-বাছাইয়ের নামে দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়ে তালিকায় নাম না ওঠার কারণে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও যদি সরকার ঘোষিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হবে।

আমি আজকে মূলত লিখতে চেয়েছিলাম, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। তারা এ দেশকে মুক্ত করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত লড়ে গেছেন। তবে, দেশটি যে স্বাধীন হয়েছে, সেটা দেখে যেতে পারেননি। শহীদদের সংখ্যা নিয়ে যখন বিতর্ক উঠে, সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে হয়। অনেক সময় বিষয়টি এমনভাবে সামনে আসে যে, কয়জন শহীদ হয়েছিলেন— একজন, এক শ, এক হাজার, এক লাখ, দশ লাখ কিংবা তিরিশ লাখ— এ সংখ্যাটিই যেন একটা বড় বিষয়! কেন? নিজেদের ন্যায্য পাওনাটুকু বুঝে পাওয়ার জন্য একজন মানুষকেও জীবন দিতে হবে কেন? যতক্ষণ না আপনার কাছে মানুষের জীবন সস্তা বলে বিবেচিত হবে, আপনার কাছে সংখ্যাটা বড় হয়ে উঠবে না।

তবে, যে প্রশ্নটি এখানে থেকে যায় তা হলো— আমরা জ্ঞাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে কতটুকু সফল হয়েছি? আবারও সেই আগের যুক্তিটাই দিতে হচ্ছে। একটা এলাকায় যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি কিংবা এলাকা থেকে সন্দেহজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন, সেটা ওই এলাকার কম-বেশি সবারই জানা থাকার কথা। সেদিন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, সেই প্রজন্মের অনেকেই এখনো আমাদের মাঝে আছেন। কাজেই, আমরা যদি সিরিয়াস হই, একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, তারা অনেক আগেই এসব কিছুর অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তবে, জাতি হিসেবে আমরা যদি সামনে এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে এ জাতির জন্য আত্ম-উৎসর্গকারী বীর সেনানীদের আমাদের স্বার্থেই স্মরণে রাখা চাই। কারণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তারাই হয়ে থাকবেন আমাদের পথিকৃৎ, অনুপ্রেরণার উৎস।

কাজেই, আর দেরি কেন? এলাকাভিত্তিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জ্ঞাত শহীদানের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে স্ব স্ব এলাকার ইউপি কার্যালয় বা অন্য কোথাও এক একটি অনার বোর্ড স্থাপনের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করার এখনই সময়।

লেখক: ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন, অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Uncovering the silent deaths of migrant women

In the shadows of booming remittance flows and the quiet resilience of Bangladesh’s labour diaspora, a disturbing reality persists: numerous Bangladeshi female migrant workers, particularly those employed as domestic help in Gulf countries, are returning home in coffins.

18h ago