পদ্মা সেতু: প্রত্যাশা ও প্রতিজ্ঞার মেলবন্ধন
স্বপ্নটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, আর তা বাস্তবায়ন করলেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর গতকাল দুই প্রান্তের দুটো জেলাকে সংযুক্ত করল পদ্মা সেতু।
ছিল অনেক বাধা, ছিল অর্থের সংস্থান নিয়েও অনিশ্চয়তা। দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছিল এমন অভিযোগ উঠেছিল প্রথমেই। ঋণ প্রস্তাব বাতিল করেছে বিশ্বব্যাংক। ছিল দেশে বিদেশে সমালোচনা। এসবের পাশাপাশি ছিল প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জও। বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মা এবং এই নদীর তলদেশে মাটির স্তরের গঠন নিয়েও ছিল জটিলতা।
তবে এত জটিলতার বিপরীতে ছিলেন একজন স্টেটসম্যান শেখ হাসিনা। ছিল তার নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকা, আর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস। সবকিছু উপেক্ষা করেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী, করেছেন তার স্বপ্ন এবং চ্যালেঞ্জের বাস্তবায়ন।
দেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পদ্মা সেতু শুধু মাত্র একটি অবকাঠামো নয়, এটা দেশের সক্ষমতার প্রতীক, আত্মমর্যাদার প্রতীক। আমাদের অন্যতম অহংকার ও গৌরবের প্রতীক। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাঙালির গর্বের আরেকটা নতুন সংযোজন পদ্মা সেতু।
’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইস্তেহারে যমুনা, বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যার উপরে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন।
কিন্তু ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর পদ্মা সেতুর স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে এই স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথ মসৃণ ছিল না।
২০১২ সালের ২৯ জুনে দুর্নীতির অভিযোগে ১২০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। তাদের সঙ্গে এই প্রকল্প থেকে সরে যায় এডিপি, জাইকা এবং আইডিবির মতো উন্নয়ন সহযোগীরা।
বিশ্বব্যাংক সরে যাবার এক সপ্তাহের মধ্যে ২০১২ সালের ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। সংসদের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে কোন কোন খাত থেকে পদ্মাসেতুর নির্মাণ ব্যয় সংগ্রহ করা হবে সেটাও বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় প্রাথমিকভাবে দেশীয় অর্থায়নেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে৷ এরপর কোনো দাতা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে চাইলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷
বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগের পর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, উপদেষ্টা এবং তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ অনেকের বিরুদ্ধে।
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও বারবার শেখ হাসিনা সেটাকে নাকচ করেছেন। ২০১২ সালের জুলাইয়ে সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি বলেন বাংলাদেশ প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে৷ তবুও কোনো অযৌক্তিক আবদার মেনে নেওয়া হবে না৷
শেখ হাসিনা আরও বলেন, তিনি বা তার পরিবারের সদস্যরা কোনোরকম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন৷ তার নাম ভাঙিয়ে কেউ কিছু করলে সরাসরি তাঁকেও জানানোর আহ্বান জানান তিনি৷
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক নিজেরা তদন্ত শুরু করে এবং তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই তারা কানাডা পুলিশকে সেদেশের এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে।
পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচার প্রক্রিয়া শেষে কানাডার একটি আদালত ২০১৭ সালের ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সেই দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলা খারিজ করে দেয়। আদালত রায়ে বলেন, এই মামলায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে সেটা অনুমান ভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজব। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতিসহ পুরো মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত।
সেই সময় বাংলাদেশ আবারও দাবি করে দুর্নীতি নয়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই ওই অভিযোগ আনা হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রস্তাব বাতিল করার পর দেশের তরফে বিশ্বব্যাংকে এই প্রকল্পে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হতে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন শর্ত এবং প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পর্কে দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেতু প্রকল্পের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ সহায়তার অনুরোধ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ।
পরে ২০১৪ সালের নভেম্বরে শুরু হয় মূল সেতুর কাজ, সঙ্গে স্বপ্ন বাস্তবায়নেরও। অনেককেই এটাকে দিবাস্বপ্ন কিংবা অসম্ভব বলেও মন্তব্য করেছেন। অনেকেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ ভায়েবল নয় বলেও মন্তব্য করেন।
কিন্তু কোনো কিছুই শেখ হাসিনাকে তার জায়গা থেকে সরাতে পারেনি, পারেনি দমাতে। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মূল সেতুর নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বড় কাজ করতে গেলে ‘হাত পাততে হবে’ এ মানসিকতা ভাঙতেই নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। ‘আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, আমরা তা দেখাব। আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি। বাঙালি জাতি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না।’
দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে শেখ হাসিনা এগিয়ে গেছেন স্বপ্ন বাস্তবায়নে। দেখিয়েছেন কিভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করতে হয়।
কয়েকটি পাইলিং-এর গভীরতা বেশি থাকায় জার্মানি থেকে আনতে হয়েছিল বিশ্বের সবচাইতে বড় তিন হাজার কিলোজুল শক্তিসম্পন্ন ৩৮০ টন ওজনের হ্যামার। সর্বশেষ করোনার কারণে কাজ থমকে না গেলেও, গতি শ্লথ হয়েছে।
সব কিছু মোকাবিলা করে মাওয়া আর জাজিরাকে সংযুক্ত করলে ৪২টি পিলারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু। এতদিন স্বপ্নের সেতু বলা হলেও আজ সেটা বাস্তব সত্য।
এই সংযোগ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে ওই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এ অঞ্চলে আসবে বিনিয়োগ ও হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ, অর্থনীতিতে আসবে গতি।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, এত সমস্যা মেকাবিলা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখা এবং সেটার বাস্তবায়নের জন্য একটা স্যালুট শেখ হাসিনার প্রাপ্য।
আর সাথে সুকান্ত ভাট্টাচার্যের ‘দুর্মর’ কবিতার এই লাইনটাই হোক আমাদের আজকের দিনটার শ্লোগান...
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়:
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়!
পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য: চিফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments