শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

নেই পূর্ণাঙ্গ তালিকা, স্মৃতিরক্ষার উদ্যোগ নেই ৪৯ বছরেও

কামিনীকুমার ঘোষ, অবণী মোহন দত্ত, নূতন চন্দ্র সিংহ ও ডা. মুহাম্মদ শফী। (বাম দিক থেকে ডানে)

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা এখন পর্যন্ত নেই। এমনকি যাদের নাম জানা যায়, তাদের স্মৃতি সংরক্ষণেরও তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি বারবার উত্থাপিত হলেও বরাবরই রয়ে গেছে উপেক্ষিত।

নাগরিক সমাজ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে অনেকের নামে সড়ক ও চত্বরের নামকরণ হয়েছে। কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি রক্ষার্থে সেই ধরনের কোনো পদক্ষেপ‌ও গ্রহণ করা হয়নি।

স্মৃতিতে অম্লান

কামিনীকুমার ঘোষ

১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান কামিনীকুমার ঘোষকে।

কামিনীকুমারের জন্ম ১৮৮৮ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী কামিনীকুমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সব পরীক্ষায় বৃত্তিসহ উত্তীর্ণ হন। একজন মানবতাবাদী ও খ্যাতনামা আইনজীবী হিসেবে সুদীর্ঘ ৫০ বছর মানুষের সেবা করেছেন। চট্টগ্রামে তিনি রায়সাহেব কামিনীকুমার ঘোষ নামে পরিচিত ছিলেন। নিজ এলাকায় শিক্ষা বিস্তার ও জনসাধারণের কল্যাণে ব্যাপক উদ্যোগ নেন। তিনি অনেকগুলো সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। সাতকানিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি।

স্মৃতিচারণ করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন বলেন, ‘কামিনীকুমার ঘোষকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও জনহিতৈষী ব্যক্তি ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী ও প্রাজ্ঞ এই মানবতাবাদী মানুষটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোষানলে পড়েছিলেন এলাকায় তার জনপ্রিয়তার জন্য। পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা তাকে ২৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।’

কামিনীকুমার ঘোষের ছেলে শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর ভিপি ছিলেন, বলেন তিনি।

নিজ গ্রামে তার একটি স্মৃতিফলক থাকলেও চট্টগ্রাম শহরে তার স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বলেন ড. অনুপম।

অবণী মোহন দত্ত

চট্টগ্রাম কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান অবণী মোহন দত্ত। পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈতনিক খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। প্রগতিশীল এই শিক্ষক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোষানলে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার অবস্থানের কারণে। পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের ৮ মে চট্টগ্রাম শহরে তার বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।                

অবণী মোহন দত্তের ছাত্র ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শফিকুল আলম বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। অবণী স্যার ছিলেন আমাদের শিক্ষক। অত্যন্ত ভালো শিক্ষকই কেবল তিনি ছিলেন না, অবণী স্যার ছিলেন একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ। তিনি ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি।’

মানবতাবাদী এই শিক্ষাবিদ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লক্ষ্যে পরিণত হন তার প্রগতিশীল ভূমিকা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থানের কারণে, বলেন ড. শফিকুল।

ড. অনুপম সেন বলেন, ‘অবণী বাবু চট্টগ্রাম কলেজে বদলি হয়ে আসেন ১৯৭০ সালে। আমি তখন সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক এবং পরবর্তীতে সহকর্মী অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব আমাকে অনুরোধ করলেন অবণী বাবুকে যেন কিছুদিন আমার বাসায় রাখি, যেহেতু তিনি চট্টগ্রামে তখন নতুন। ফলে তখন মাস তিনেক তিনি শহরের নালাপাড়ায় আমার বাসায় ছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘তাকে যতটুকু জেনেছি অত্যন্ত ভালো ও নরম মনের মানুষ ছিলেন। আর ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। পাক হানাদার বাহিনী তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে।’

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, তার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ফলে নতুন প্রজন্মের অনেকেই তার বিষয়ে কিছুই জানে না। সরকারের উচিত শহীদ বুদ্ধিজীবী অবণী মোহন দত্তের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য অবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করা, বলেন ড. অনুপম ও ড. শফিকুল।

নূতন চন্দ্র সিংহ

শহীদ বুদ্ধিজীবী নূতন চন্দ্র সিংহ ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ও মানবতাবাদী। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা তাকে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল তার নিজ বাসভবন চট্টগ্রামের রাউজান থানার কুণ্ডেশ্বরী ভবনে মন্দিরের সামনে নির্মমভাবে হত্যা করে।

নূতন চন্দ্র সিংহের জন্ম ১৯০১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানায়। শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে নয় বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষনে বার্মায় চলে যান। ১৯২২ সালে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। তারপর কলকাতায় যান। ১৯৪৬ সালে একটি ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় হিসেবে ব্যাপক প্রসিদ্ধ হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। তখন রাউজান থানায় কোনো স্কুল ছিল না। মেয়েরা দূরের স্কুলে গিয়ে লেখাপড়ার করতে পারত না। নারী শিক্ষার প্রসারে তিনি রাউজানে প্রতিষ্ঠা করেন কুণ্ডেশ্বরী বালিকা মন্দির, যা ছিল সম্পূর্ণ আবাসিক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দূর-দূরান্ত থেকে মেয়েরা সেখানে পড়তে আসত।

রাউজান পৌরসভার মেয়র ও শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি সংসদের সহ-সভাপতি দেবাশীষ পালিত বলেন, ‘নূতন চন্দ্র সিংহ মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭ জন প্রগতিশীল শিক্ষক ও তাদের পারিবারকে আশ্রয় দেন। তার মধ্যে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক এ আর মল্লিক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) অন্যতম। এই খবর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা জেনে যায়। আশ্রিত শিক্ষক ও তাদের পারিবার ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেও তিনি কিছুতেই নিজের দেশ ছেড়ে যেতে রাজি হননি।’

নূতন চন্দ্র সিংহর নাতি রাজীব সিংহ বলেন, তার দাদুর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ‘আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম অন্তত একটি হলের নামকরণ যেন নূতন চন্দ্র সিংহর নামে করা হয়।’

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালের বিজয় দিবসে নূতন চন্দ্র সিংহ স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ২০১১ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।

ডা. মুহাম্মদ শফী

মুহাম্মদ শফীর জন্ম ১৯১৫ সালের ৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। তিনি কলকাতা ডেন্টাল কলেজ থেকে দন্ত চিকিৎসায় ডিপ্লোমা ও পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন ও শহরের এনায়েতবাজার বাটালি হিলে বাসা ও চেম্বার দেন। তিনি ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনে ভূমিকা পালনকারী, বলছিলেন ড. অনুপম সেন।

পাক হানাদার বাহিনী তাকে এবং তার শ্যালক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালের ছাত্র খোন্দকার এহসানুল হককে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল, বলেন ড. অনুপম। পরবর্তীতে তাদের দুজনকেই হত্যা করা হয়।  

পেশাগতভাবে চিকিৎসক পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন একজন সব্যসাচী লেখক। তার স্ত্রী মুশতারি শফী নারীদের জন্য প্রকাশিত একটি মাসিকপত্র ‘বান্ধবী’র সম্পাদনা করতেন। মুহাম্মদ শফী ছিলেন ‘বান্ধবী’র প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর তার স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা ফারুকী আজম বীর প্রতীক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সকল বুদ্ধিজীবীর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমে প্রয়োজন তাদের একটি সঠিক তালিকা তৈরি করা যাতে নতুন প্রজন্ম তাদের সম্পর্কে জানতে পারে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সারাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির জন্য সরকার সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করেছে।

সরকারি নির্দেশনা অনুসারে চট্টগ্রামে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago