‘স্যার, একটু বাইরে আসবেন’

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী তাদের দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার মাধ্যমে পুরো জাতিকে মেধাহীন করার নীল-নকশা করেছিল। তারা বেছে বেছে হত্যা করেছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান— শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় রয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক।
শহীদ মীর আবদুল কাইয়্যুম
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একজন মীর আবদুল কাইয়্যুম ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
১৯৩৯ সালের ৬ জুলাই ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ের ঘাগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। মীর আবদুল কাইয়্যুম ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগে এমএ-তে ভর্তি হন।
১৯৬২ সালে তিনি এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর দুই বছর রিসার্চ সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র হিসেবে, পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবেও অধ্যাপক কাইয়্যুম ছিলেন মুক্ত মনের অধিকারী। তিনি মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। যে কোন পরিস্থিতিতে তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে কথা বলতে কখনো দ্বিধা করেননি।
সেই দুর্ভাগ্যের রাতটি এসেছিল একাত্তরের ২৫ নভেম্বরে। এর আগে মীর আবদুল কাইয়্যুম রাজশাহী শহরের মালোপাড়ায় থাকলেও সে রাতে তিনি ঘোড়ামারায় শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করছিলেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মীর আবদুল কাইয়্যুমের মেয়ে ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া দ্য ডেইলি স্টারের কাছে সেই রাতের বর্ণনা দিয়েছেন তার মা ও একই বিভাগের শিক্ষক মাসতুরা খানমের বরাত দিয়ে।
ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া বলেছেন, ‘তখন রাত ৮টা। বাড়ির দরজায় কেউ একজন টোকা দিয়েছিলেন। দরজায় শব্দে কাইয়্যুম ও তার সাত মাসের সন্তান-সম্ভাবা স্ত্রী ভয়ে হিম হয়ে ছিলেন।
বাইরে থেকে সুন্দর বাংলায় আওয়াজ এলো, ‘স্যার, আপনি কি একটু বাইরে আসবেন?’
স্ত্রী মাসতুরা তখন দরজা খুলতে চাননি। কিন্তু স্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও কাইয়্যুম সঙ্গে আইডি কার্ড নিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে যান।
তিনি বের হয়ে দেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিভাগের তৈয়ব আলী নামের এক অবাঙালি কর্মচারী দাঁড়িয়ে আছেন।
তৈয়ব তাকে জানান, এক ক্যাপ্টেন তাকে দেখা করার জন্যে ডেকেছেন। উনি বাইরে গাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করছেন।
তখন তৈয়বের দেখানো পথে শেষবারের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে যান মীর আব্দুল কাইয়্যুম এবং আর ফিরে আসেননি।
বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সে সময় আটককৃত সবাইকে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হতো। যেখানে পাকিস্তানি হানাদারদের টর্চার সেল ছিল।
বাঙালিদের ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করে মেরে ফেলার পর, হলের পিছনে লাশ ফেলা হতো।
‘অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কাইয়্যুমের লাশ সেখানে পাওয়া যায়নি’ উল্লেখ করে ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া আরও বলেছেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩০ ডিসেম্বর স্থানীয় লোকজন রাজশাহীর পদ্মা পাড়ে বোয়ালিয়া ক্লাবের পাশে বাবলাতলায় একটি গণকবর চিহ্নিত করেন। সেখান থেকে মীর আবদুল কাইয়্যুমসহ ১৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।’
‘পরে কাইয়্যুমের মরদেহ হেতেম-খা কবরস্থানে দাফন করা হয়,’ যোগ করেন তিনি।
জানা গেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজশাহী শহর থেকে মীর আবদুল কাইয়্যুমসহ ১৪ বুদ্ধিজীবীকে ওই রাতে একই কায়দায় আটক করেছিল।
গণ তদন্ত কমিশনের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, যে ১৪টি মরদেহ দড়িতে বাঁধা ছিল এবং তাদের দেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাদেরকে সম্ভবত জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মীর আব্দুল কাইয়্যুমের নামে একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞান বিভাগের সেমিনার গ্রন্থাগারটির নামকরণ করা হয়েছে তার নামে।
এছাড়াও, ১৯৯৫ সালে পদ্মা বাঁধে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়।
শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন সুখরঞ্জন সমাদ্দার। তিনি ছিলেন অতি সাধারণ, শান্তিকামী, অরাজনৈতিক একজন ব্যক্তিত্ব।
সুখরঞ্জন সমাদ্দার ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি বরিশালের বানারিপাড়ার ইলুহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন।
মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। তিনি সংগীতচর্চা করতেন।
পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ যখন চলমান, তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কারফিউয়ের মতো পরিস্থিতি ছিল। সে সময়ে খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষকই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছিলেন তাদেরই একজন।
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্ত্রী চম্পা সমাদ্দার দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাড়ার আবাসিক এলাকার ৭১/বি নম্বর বাসায় থাকতেন।
একাত্তরের ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নগরবাড়ী নদী টার্মিনাল হয়ে রাজশাহীতে ঢুকেছিল। তারা রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পশ্চিম পাড়ায় ৬৯/বি নম্বর বাসায় ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। সেটি ছিল সুখরঞ্জন সমাদ্দারের বাসার ঠিক সামনেই।
ঘটনার দিন ১৪ এপ্রিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পাকিস্তান সেনারা সুখরঞ্জন সমাদ্দারের বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে।
তারা পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদস্যদের খোঁজ করার কথা বলে বাড়িতে প্রবেশ করে। কিন্তু, সুখরঞ্জনকে না পেয়ে সেনারা ফিরে যায়।
এ ঘটনার পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন অবাঙালি চেয়ারম্যান সৈয়দ মতিউর রহমান পাকিস্তান সেনাদের ডেকে এনে জানায় যে, সমাদ্দার মুসলিম নয়, বরং একজন হিন্দু। তখন পাকিস্তান সেনারা তাকে টেনে হিচড়ে তুলে নিয়ে যায়।
চম্পা সমাদ্দার বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী আমার স্বামীকে তুলে নেওয়ার প্রায় সাতদিন পর আমরা জানতে পারি। একাত্তরের জুলাইয়ে হত্যাকারীদেরই এক সহযোগী আমার কাছে এসে আমার স্বামীর মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি আমাকে আর স্বামীর ব্যবহার করা ভাঙা চশমা এবং স্যান্ডেল দিয়েছিলেন।’
‘অনেক পরে আমরা জানতে পারি, তাকে তুলে নেওয়ার দিনেই নির্মমভাবে হত্যা করে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় ফেলে রাখা হয়েছিল।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুখরঞ্জন দেহাবশেষ উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে পুনঃসমাহিত করে।
শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দারের সম্মানার্থে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
হবিবুর রহমান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তিন শিক্ষক শহীদ হয়েছেন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান তাদের একজন।
হবিবুর রহমানের জন্ম ১৯২১ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বালিয়াধর গ্রামে। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
তার কয়েকজন সহকর্মী ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, একাত্তরের ১৫ এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি সেনারা এসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসা থেকে হবিবুর রহমানকে তুলে নিয়ে যায়।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনে নেওয়া হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কবে, কোথায় কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়, তা পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেননি। তার মরদেহও পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ হবিবুর রহমানের নামে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়াও, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক’ নির্মাণাধীন আছে।
Comments