কিশোর মুক্তিযোদ্ধা টিটোর স্বাধীনতা
শহীদ গোলাম মোহাম্মদ দস্তগীর টিটো। একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৫৫ তে জন্ম নেয়া ১৬ বছরের টগবগে কিশোর। শায়িত আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের ঠিক উল্টো পাশে। মাঝখানে ফারাক শুধু ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দুটি লেন। এমন এক সাহসী যোদ্ধা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই জানেন না। জানার আয়োজনও অপ্রতুল।
মানিকগঞ্জের উত্তর শেওতা গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র টিটো ছিলেন ভীষণ সাহসী। দেশের স্বাধীনতায় অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। তারই অংশ হিসেবে ৮ ডিসেম্বর অবস্থান নেন সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানার ইয়ারপুর ইউনিয়নের তৈয়বপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। অংশ নেন বিভিন্ন সম্মুখ সমরে।
১৯৭১ সালের শেষ দিকে পাকবাহিনীর সদস্য এবং তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিভিন্ন এলাকায় নাস্তানাবুদ হচ্ছিল। তাই তারা পিছু হটে ঢাকার দিকে ফিরছিল। এ সময় ঢাকা উত্তর গেরিলা ইউনিটের প্রধান শহীদ রেজাউল করিম মানিকের গেরিলা দলের মূল দায়িত্ব ছিল ঢাকার উত্তরাঞ্চলের কোথাও সেতু উড়িয়ে দিয়ে, ব্যারিকেড দিয়ে অথবা রাস্তা কেটে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে শত্রুবাহিনীর যোগাযোগ বা চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো। এমনই এক অভিযানে ধামরাইয়ের কালামপুরের অদূরে ডাউটিয়া সেতুটি ডিনামাইটের সাহায্যে ধসিয়ে দেওয়ার অপারেশনে গ্রুপ কমান্ডার মানিকসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ১৩ নভেম্বর শহীদ হন। এরপর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়া পর্যন্ত গ্রুপটির কমান্ডার ছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।
১৪ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দু’দিন আগে। ক্যাম্পে খবর আসে পাক হানাদার বাহিনীর ৩০-৪০ জনের একটি দল টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে ঢাকার ক্যাম্পে ফিরছে। সে অনুযায়ী কমান্ডার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে একটি দল আশুলিয়ার জিরাব এলাকার ঘোষবাগ-গঙ্গাবাগ গ্রামে অবস্থান নেন। পাক হানাদার বাহিনী সেখানে পৌঁছালেই শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চুর গেরিলা বাহিনী।
শহীদ টিটোর সঙ্গে সেই যুদ্ধে অংশ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহের আলীও।
জাহের আলী দ্য ডেইলি স্টারকে সেদিনের স্মৃতির কথা জানান, ‘আমরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে সতর্ক অবস্থান নিই। যুদ্ধ শুরু হলে টিটো আমার পাশেই যুদ্ধ করছিলেন। আমাদের আগ্রাসী আক্রমণে পিছু হটছিল পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছিল। গোলাগুলিতে কয়েকজন সেনা নিহতও হয়। পিছু হটতে হটতে ওরাও পাল্টা গুলি করছিল। এর মধ্যেই টিটো মাথা তুলে গুলি করতে উদ্যত হয়। এতে টিটোর শরীরের ডানদিকে গুলি লাগে। ওকে আমরা আহত অবস্থায় নিয়ে আসি। একজন পাকসেনাকেও আহত অবস্থায় ধরতে সক্ষম হই।’
জাহের আলী বলেন, ‘মুমূর্ষু টিটোকে পার্শ্ববর্তী ডেইরি ফার্মে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে ক্ষত থেকে রক্ত বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শহীদ হন টিটো। পরে সাভার ডেইরি ফার্ম গেইটের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধার ঘেঁষে সমাধিস্থ করা হয় টিটুকে।’
টিটোর সাহসিকতা নিয়ে জাহের আলীর জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ‘নয়ামিয়া নামে পাক বাহিনীর এক দোসরকে ধরার সিদ্ধান্ত হয়। যিনি পাক বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছিলেন। প্রথম গ্রেনেডটিই ছুঁড়েছিল টিটো। যেই স্মৃতিটি এখনও আমার মনে পড়ে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন অরক্ষিত অবস্থায় সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার (ডেইরি ফার্ম) এর ঝোপের মধ্যে পড়েছিল শহীদ টিটোর কবর। পরে ১৯৯৯ সালে সাভার সেনানিবাসের নির্মাণে ‘টিটোর স্বাধীনতা’ নামে একটি স্মৃতিফলক তৈরি হয়।
কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার উপপরিচালক ডা. মোহাম্মাদ আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শহীদ টিটো ফাউন্ডেশনের সদস্যরা স্মৃতিফলক দেখভাল করেন। যেহেতু আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে একদম প্রতিবেশী হিসেবে একজন সাহসী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শায়িত আছেন, আমরা সবসময় পরিপাটি করে রাখার চেষ্টা করি।’
সাভারের লাল মাটিকে আরও লাল করে অসীম সাহসী প্রাণ টিটোর হৃদস্পন্দন থেমে গেছে দেশ স্বাধীনের ঠিক দুদিন আগে। তবে সেদিনেই সাভার হয়েছে শত্রুমুক্ত। ১৬ই ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পেয়েছে এক বিজয়, এক স্বাধীনতা। যার শ্রমে রয়েছে শহীদ টিটোর মতো লাখো শহীদের আত্মত্যাগ।
Comments