অপহরণ-ধর্মান্তর-মৃত্যু: তদন্তের গাফিলতিতে লাকিংমে চাকমার করুণ পরিণতি?
‘আমার নাম উথাইন চিন। আমার বয়স ২৯ বছর। লালা অং এর মেয়ে লাকিংমে চাকমা। তার বয়স প্রায় ১৫ বছর। গত ৫ জানুয়ারি লাকিংমের বাড়িতে তার বাবা-মা ছিল না। এই সুযোগে ইয়াছিন, মোহাম্মদ ইসা, ও আব্বুইয়া সন্ধ্যা ৬টার দিকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় লাকিংমেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। আমরা লাকিংমের চিৎকার শুনে তাকে উদ্ধারে পিছু ধাওয়া করলে তারা অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়।’
লাকিংমে চাকমা অপহরণ মামলার একজন সাক্ষীর জবানবন্দি এটি। কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গত ৫ ফেব্রুয়ারি এই জবানবন্দি রেকর্ড করে।
কমপক্ষে পাঁচ জন সাক্ষী জবানবন্দিতে বলেছিল, লাকিংমেকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু পিবিআই গত ৯ আগস্ট কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে প্রতিবেদন দিয়ে জানায় লাকিংমে চাকমাকে অপহরণের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। বরং অংকাহ্লা চাকমা নামে একজন লাকিংমেকে তার বান্ধবী নাছিমা আক্তার, নাছিমা আক্তারের বন্ধু রিয়াজ উদ্দিন এবং অভিযুক্ত একজন আসামি আব্বুইয়াকে একসঙ্গে একটি বাগানে দেখে ফেলায় সম্ভাব্য পরিণতির ভয়ে লাকিংমে বাড়ি থেকে অজ্ঞাত জায়গায় চলে যায়।
অপহরণের প্রায় এক বছর পর গত বৃহস্পতিবার লাকিংমে চাকমাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অপহরণের পর তাকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল।
পিবিআই এর তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ক্যশৈনু মারমা।
অভিযোগ অস্বীকার করে ক্যশৈনু এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্লিজ কোর্টে আমি যেভাবে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি আপনিও সেভাবে লিখেন।’
তদন্ত প্রতিবেদনের বক্তব্যের ব্যাপারে লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অপহরণকারীদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে আমার মেয়েকে অপহরণ করা হয়নি বলে ক্যশৈ নু মিথ্যা প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছেন।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সেদিন যদি সঠিক প্রতিবেদন দেওয়া হতো তাহলে মেয়ের এমন করুণ মৃত্যু আমাদের দেখতে হত না।’
‘কিভাবে আমরা এখানে টিকে থাকব? আমাদের মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হলো। গরিব বলেই কি রাষ্ট্র আমাদের পাশে নেই? আমরা কি দেশে বাস করতে পারব?’ বিলাপ করে বলছিলেন লাকিংমের আত্মীয় অং ক্য হ্লা।
কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুনির উল গীয়াস বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তথ্য পেয়ে আমরা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গিয়ে লাকিংমেকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই।’
উপপরিদর্শক আব্দুল হালিম বলেন, ‘আতাউল্লাহ নামে একজন নিজেকে লাকিংমের স্বামী দাবি করে বলেন লাকিংমে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টায় বিষ খেয়েছে।’
অং ক্য হ্লা বলেন, ‘বৃহস্পতিবার যখন আমাদেরকে পুলিশ থানায় ডেকে পাঠাল তখন আতাউল্লাহ থানার হাজতে ছিল। আমরা অবাক হয়েছি পরবর্তীতে যখন পুলিশ আতাউল্লাহ কে ছেড়ে দিল।’
কক্সবাজার পিবিআই পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার সোমবার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যদি ভিকটিমের পরিবার আমাদের কাছে আসে আমরা এই কেসটি পুনরায় তদন্ত করব।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলী বলেন, ‘আমরা জানতাম না লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়েছিল এবং সে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিল। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের একটা ডকুমেন্ট দেখেছি যেখানে চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছেন লাকিংমের বয়স ১৮ বছর।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘যদি পিবিআই অনৈতিক এবং পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন দিয়ে থাকে তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।’ ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
লাকিংমে অপহৃত হওয়ার পরের ঘটনাক্রম সম্পর্কে তার বাবা লালা অং চাকমা বলেন, ‘৫ জানুয়ারি অজ্ঞাত কিছু দুষ্কৃতিকারী বাড়ি থেকে আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। মামলা করার জন্য টেকনাফ থানায় গেলে তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আমাদের মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেন। পুলিশ অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদেরকে সহযোগিতা করেছে।’
‘পরে আমরা জানতে পারি অপহরণকারীরা ছিল স্থানীয় মো. আতাউল্লাহ, ইয়াসিন, মো. ইসা, আব্বুইয়াসহ অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচ জন। যেহেতু পুলিশ আমাদের কোনো সহযোগিতা করেনি, তাই আমি জানুয়ারির ১৭ তারিখ কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মেয়েকে উদ্ধারের জন্য মামলা করি,’ বলেন লালা অং।
আদালত পরে পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়। গতকাল পিবিআইের তদন্ত প্রতিবেদনে পিতা লালা অং নারাজি দিলে আদালত র্যাবকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অধিকতর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
লালা অং চাকমা বলেন, ‘আমার মেয়েকে অপহরণ করা হলো, ধর্মান্তরিত করা হলো, অবশেষে মেরে ফেলা হলো। মেয়ের মরদেহের জন্য বৃহস্পতিবার থেকে আমরা নানান জায়গায় আকুতি জানিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের আর্তনাদ কেউ শুনতে পাচ্ছে না।’
আরও পড়ুন:
Comments