রাজশাহী মুক্ত হয় বাংলাদেশ স্বাধীনের ২ দিন পর

বিজয় দিবসের দুই দিন পর ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী শহর পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়েছিল।
পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত রাজশাহীতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

বিজয় দিবসের দুই দিন পর ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী শহর পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর-৭ এর আওতাধীন সাব-সেক্টর-৪ এর অধিনায়ক মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বীর বিক্রম ১৮ ডিসেম্বর বিকেলে শহরের মাদ্রাসা ময়দানে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থেকে রাজশাহীকে মুক্ত ঘোষণা করেন।

রাজশাহীতে যুদ্ধকালীন সাংবাদিক আহমেদ শফি উদ্দিন ও শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

আহমেদ শফি উদ্দিন তৎকালীন সাপ্তাহিক ‘সোনার দেশ’ এর প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘সোনার দেশ’র সব সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ জারি করেছিল। এর ফলে সাংবাদিকরা গ্রামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। শফি বিজয়ের সপ্তাহ দুয়েক আগে শহরে ফিরে আসেন।

তিনি বলেন, ‘আমি সেই সময়ে একটি ডায়েরিতে সেই দিনগুলির নোট রেখেছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, সেসব নোটে ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী মুক্ত হওয়ার প্রমাণ আছে।

‘রাজশাহী তখন ছিল মৃত এক নগরী। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতায় শহরের রাস্তাঘাট ছিল ভয়ার্ত নীরব ও জনমানবহীন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে মানুষজন তখনও বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল,’ বলেন শফি।

‘কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহরে প্রবেশ করেন এবং অন্যরা রাত ৮টার দিকে। রাত ১২টার দিকে মেজর গিয়াস শহরে প্রবেশ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা যখন শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের জন্য নাটোরের দিকে পিছু হটতে শুরু করে ‘ তিনি তার ডায়েরিতে লেখা নোটের বরাত দিয়ে বলেন।

পরদিন ১৮ ডিসেম্বর সকালে, ভারতীয় সেনাবাহিনী যারা মিত্র বাহিনীর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছিলেন তারা শহরে পৌঁছে এবং রাজশাহী কলেজ মাঠে তাঁবু স্থাপন করে— ডায়েরি থেকে পড়ে বলেন শফি।

‘আমার স্পষ্ট মনে আছে মিত্র বাহিনীর সদস্যরা শ্রান্ত ও অভূক্ত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছিলাম রিকশায় দাঁড়িয়ে শহরবাসীকে খাবার দেওয়ার জন্য চিৎকার করতে। শহরের লোকেরা তাদের খাবার দেয়। আমাদের পরিবার তাদের রুটি ও মুরগির মাংস রান্না করে দিয়েছিল। অন্যরা ভাত, মুড়ি, চিড়া, মিষ্টি— যে যা খাবার পেরেছিলেন তাই তাদের দিয়েছিলেন।

‘শহরের লোকেদের আবেগের বিস্ফোরণ ঘটে ১৮ ডিসেম্বর। এদিনেই রাজশাহীর মানুষ বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়েন। আমাদের বাড়ির নারীরা তাদের শাড়ি কেটে বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত পতাকা নিজের হাতে সেলাই করেন। এরকম আরও অনেকেই করেছেন। সেই পতাকা হাতে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। জয়বাংলা স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে চারিদিক,’ বলেন সাংবাদিক শফি।

বিকেলে মাদ্রাসা ময়দানে জনসভা হয়। জনসভায় রাজশাহীর রাজনৈতিক নেতা আতাউর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেসবাহুল হক বাচ্চু, নাটোরের শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী, নওগাঁর মইনউদ্দিন মন্ডল, আজহারুল ইসলাম ও রইসউদ্দিন বক্তব্য রাখেছিলেন।

জনসভায় মেজর গিয়াস জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং ঘোষণা করেন যে ‘আজ থেকে রাজশাহী হানাদার মুক্ত’।

১৯ ডিসেম্বর রাজশাহী কলেজ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল এবং লোকেরা সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য জড়ো হয়েছিল।

আহমেদ শফি উদ্দিন জানান, তিনি নিজেও তখন ভারতীয় সেনা কমান্ডারের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।

রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারাও রাজশাহী মুক্ত হবার সম্পর্কে একই কথা বলেন।

রাজশাহী সদর মহাকুমায় গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শফিকুর রহমান রাজা বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী শহরের চারপাশে বুবি ট্র্যাপ স্থাপন করেছিল এবং শহরে ঢোকার পথের সেতুগুলো ক্ষতিগ্রস্থ করে রেখেছিল। এজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের রাজশাহীতে ঢুকতে দুদিন সময় লাগে।

‘স্থানীয়দের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তাগুলি মেরামত করে এবং সীমান্ত এলাকার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শহরে ফিরে আসে।’

কিন্তু, স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে বিজয়োল্লাস কিছু পরেই স্তিমিত হতে শুরু করে। যখন চারিদিক থেকে গণকবর উদ্ধারের সংবাদ আসতে থাকে আর বিভিন্ন জায়গা থেকে লাশ উদ্ধার হতে থাকে, বলেন আহমেদ শফি উদ্দিন।

Comments

The Daily Star  | English
Islami Bank's former managing director Abdul Mannan

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago