হবিগঞ্জে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন: পরিবেশের ঝুঁকি বাড়ছে
হবিগঞ্জে অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে পাহাড়ি ছড়া থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। অব্যাহত এই বালু উত্তোলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। পাহাড়ি ছড়া ও খাল থেকে অপরিকল্পিত-অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে তিন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ২০ সরকারি কর্মকর্তাকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
নোটিশে পরিবেশ রক্ষায় ২৩টি সিলিকা ও সাতটি সাধারণ বালুমহালকে ইজারার তালিকা থেকে বাদ দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। বেলার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ কবীর গত ৯ ডিসেম্বর এ নোটিশ প্রদান করেন। নোটিশ দেওয়ার সাত দিনের মধ্যে নোটিশদাতাকে অবহিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি চুনারুঘাট উপজেলার অন্তর্গত দারাগাঁও গ্রামে সাম্প্রতিক সফরকালে এই প্রতিবেদক ড্রেজার ও লম্বা পাইপ ব্যবহার করে অবৈধভাবে সিলিকা বালু উত্তোলন করতে দেখেন।
দারাগাঁও গ্রামের বাসিন্দা সাদ্দাম মিয়া জানান, স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় মেশিন ও ড্রেজার স্থাপন করে কৃষিজমি ও পাহাড়ি ছড়া থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
৪৫ বছর বয়সী রফিক মিয়া জানান, ব্যবসায়ীরা পৃষ্ঠের নিচের প্রায় ৩৫-৩০ ফুট বালু উত্তোলন করছিলেন। ফলে আশেপাশের কৃষি ও পার্বত্য জমি এবং খালগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘হবিগঞ্জ সদর, বাহুবল, চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলায় চা-বাগান ও রাবার বাগানের ভেতর দিয়ে অনেক ছড়া প্রবাহিত হয়েছে। কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বিভিন্ন ছড়া থেকে অপরিকল্পিতভাবে, অবাধে ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। ছড়া ও ছড়ার পার্শ্ববর্তী স্থান থেকে অপরিকল্পিতভাবে এ কার্যক্রম রোধে স্থানীয় এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন জানায়। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে তারা বালু উত্তোলন রোধে বেলার কাছে আবেদন জানায়। এলাকাবাসীর প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে বেলার অনুসন্ধানী দল সরেজমিন পরিদর্শন করে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পায়।’
তিনি জানান, নোটিশপ্রাপ্তরা হলেন— ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব; বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব; খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব; পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক; খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক; হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক; হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার; সিলেট বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক এবং হবিগঞ্জ, বাহুবল, চুনারুঘাট ও মাধবপুর— এই চার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার ভূমি ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও হবিগঞ্জ বাপার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অপরিকল্পিত ও অননুমোদিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ছড়াগুলোর নাব্য হারাচ্ছে, ছড়ার দুই পাড় ভেঙে পড়ছে। কোথাও কোথাও ছড়ার দুই পাশের কৃষিজমি এবং চা-বাগানের জমি কেটেও বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ছড়ার পাড় সংলগ্ন কৃষিজমি, বাঁশঝাড়, গাছগাছালি ও বসতবাড়িও মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ফলে ভূমির শ্রেণির পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে।’
‘এ ছাড়াও, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করছেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে কৃষিজমির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একইসঙ্গে পরিবেশগত বিপর্যয়ের ভয়াবহতা ব্যাপক হারে বাড়বে’, বলেন তিনি।
নোটিশে চিহ্নিত স্থান থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ এবং ইজারা প্রদানের প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে একইসঙ্গে কৃষক, কৃষি ও কৃষিজমির ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে তা আদায় করার দাবিও করেছে বেলা।
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর উপ-পরিচালক মামুনুর রশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিদ্যমান খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২-সহ বিদ্যমান অন্যান্য আইন অনুযায়ী অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ পন্থায় সিলিকা বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ।’
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. এমরান হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি এখনো বেলার নোটিশ পাননি।
তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের কোনো কাযক্রম নেই। এটি জেলা প্রশাসক ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কেউ যদি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র চায়, সেক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।’
Comments