‘বিসিএসআইআর নতুন স্ট্রেইন আবিষ্কার করে বসে আছে! জানাবে না?’
করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হওয়ার পর কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে-নিচ্ছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। সেই স্ট্রেইনের কাছাকাছি ধরনের ভাইরাস প্রায় দুই মাস আগে পেয়েও চুপচাপ বসে ছিল বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। প্রশ্ন উঠেছে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বিষয়টি আগে জানানো হয়েছিল কি না? নতুন স্ট্রেইনের পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল কি না?— এ নিয়ে তিন জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, স্ট্রেইন কাছাকাছি হলে হবে না, পুরোটাই এক হতে হবে। এর ব্যাখ্যা বিসিএসআইআর দিতে পারবে। বিসিএসআইআর মাঝে মাঝেই একটা করে তথ্য দেয়। সারা পৃথিবীতে নতুন স্ট্রেইন নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে, এখন তারা বলছে দেশে এর কাছাকাছি স্ট্রেইন আগে থেকেই ছিল। তারা নতুন স্ট্রেইন আবিষ্কার করে বসে আছে! সেটা আমাদের জানাবে না? নাকি তারা গবেষণা করে যেসব তথ্য পাবে, তা নিয়ে চুপ করে বসে থাকবে?’
‘আরেকটা কথা হচ্ছে, বিসিএসআইআরে যারা জেনেটিক অ্যানালাইসিস করছেন, রোগ সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। অর্থাৎ একটা নিউ জেনেটিক স্ট্রেইন যদি পায়, সেটা যদি বিশেষজ্ঞদের না জানায়, আইইডিসিআরকে না জানায়, তাহলে সেটার কার্যক্ষমতা জানা যাবে কীভাবে? সুতরাং তাদের কথার কোনো মূল্যায়ন আমি করতে পারব না। বিসিএসআইআর সবকিছু আবিষ্কার করে বসে আছে, কিন্তু, তারা সেটা প্রকাশ করে না। অন্যরা যখন প্রকাশ করে, তখন তারা বলে যে, এটা আমরা আগে থেকেই জানি। এখন তারা যদি এমন বিভ্রান্তি করার মতো তথ্য দেয়, তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনারা যেটা পেয়েছেন, শতভাগ না হলেও অনেক মিল আছে, এটার সঙ্গে ক্লিনিক্যাল মেনিফেস্টেশনের কী সম্পর্ক আছে অথবা ট্রান্সমিশনেবিলিটির কী সম্পর্ক রয়েছে, সেটা আমাদেরকে জানান’, বলেন তিনি।
আগে থেকেই পেয়ে থাকলে সেটা বিশেষজ্ঞদের জানিয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল কি না?, জানতে চাইলে এই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটা তো অবশ্যই করণীয় ছিল। কিন্তু, তারা সেটা করেনি। নতুন তত্ত্ব পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা জানাতে হবে। আমরা তুলনা করে দেখব সেটা কী। তাই তো হওয়া উচিত ছিল। নতুন স্ট্রেইন পাওয়ার পর বিশ্বের ৪০টি দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। এটা একটা সিরিয়াস বিষয়। এমন একটা সময়ে এসে জানানো হলো, আমাদের এখানে আরও আগে সেটা পেয়েছে। যেটা পুরোপুরি এক নয়, অনেক মিল রয়েছে। সেটাতে আমাদের লাভ কী? সেটা কী তা তো আইইডিসিআরকে জানাতে হবে। যদি সেটা পেয়েই থাকেন, আইইডিসিআরকে জানান। সেখান থেকে তো আমরা সবাই জানতে পারব। তখন আমরা তুলনা করে দেখতে পারব।’
‘তাদের দায়িত্ব ছিল নতুন স্ট্রেইন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানানো। কারণ, যুক্তরাজ্যে যেরকম নতুন স্ট্রেইন উদ্ভব হলো, আমাদের দেশেও তো সেরকম একটা হতে পারে। পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানালে সেটা নিয়ে আমরা আরও গবেষণা করে দেখতে পারব। পেয়ে সেটা নিয়ে চুপ করে বসে থাকলে, এ ধরনের গবেষণা করে লাভ কী? সারা দেশে মানুষ যেখানে বিপদগ্রস্ত, সবাই ভাবছে যে, কী করা যায়, এর মধ্যে তারা এরকম একটা তথ্য দিলো। এই তথ্য তো গোপন করে রাখার মতো কোনো তথ্য না। এটা পাওয়ার পরেও তারা কেন চুপ করে ছিল?’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
করোনার নতুন স্ট্রেইন পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হবে। এটা তো এরকম না যে কোথাও কোনো পরিবর্তন হবে না। আমাদের যে গতিবিধি দেখতে হবে, তা হলো সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। বিদেশ থেকে যারা আসবে, তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে। গ্রামীণ বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব কি খুব একটা আছে? হয়তো বৈজ্ঞানিক কোনো গবেষণা নেই, কিন্তু, সামাজিক দৃষ্টিতে আমরা দেখছি করোনার সংক্রমণটা তো মূলত শহরকেন্দ্রিক। এগুলো নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে যে, প্রায়োরিটি কীভাবে সেট করতে হবে, ভ্যাকসিনেশন কীভাবে হবে।’
‘নতুন স্ট্রেইন নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। শুধু এটুকুই বলব যে, মিউটেশন ভাইরাসের অংশ। আমাদের এখানে এখনো তো পুরোপুরি অ্যানালাইসিস হয়নি। সেটা আগে করতে হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে পশ্চিমারা যেটা পারে, আমরা তো সেটা পারি না। তবে, যদি কোনো পরিবর্তন এসে থাকে, তাহলে যারা এগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে,’ বলেন অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।
যারা জিনোম সিকোয়েন্স করছে, তারা কিছু কিছু পরিবর্তন সব সময়েই পাচ্ছে বলে উল্লেখ করে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘পরিবর্তন তো আকস্মিকভাবে হয় না। পরিবর্তন হতে হতে এটা আসে। যুক্তরাজ্যে যেটা পাওয়া গেছে, সেটা খুব বড় ধরনের পরিবর্তন কি না, সেটা কিন্তু এখনো বোঝা যায়নি। এখনো বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু, তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। কারণ, বড়দিনের বন্ধতে অনেক লোক আসা-যাওয়া করছে, সেখানে সংক্রমণ-মৃত্যুও বেশি, তাই সেখানে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে অ্যালার্মিং। কিন্তু, আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতি তো একটা রেঞ্জের ভেতরে ওঠা-নামা করছে। কাজেই যেটা পেয়ে যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়েছে, সেটা যেখানে সংক্রমণ তুলনামূলক কম, সেখানে তেমন উদ্বিগ্নের বিষয় নাও হতে পারে।’
‘আর বিশ্বে যারাই জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ করবে, তাদেরকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জিআইএসএইড নামে একটা ওয়েবসাইট আছে, সেখানে পোস্ট করতে হয়। সেখানে পোস্ট করলে বোঝা যায় যে, ভাইরাসটি কত পরিবর্তন হয়েছে। কাজেই বিসিএসআইআর যদি সেটা করে থাকে, নিশ্চই তারা সেখানে সেটা পোস্ট করেছে এবং যারা জিনোম সিকোয়েন্সের বিজ্ঞানী, তাদের কাছে হয়তো ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে খবরটা গেছে। ফলে যারা বাংলাদেশে জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে হয়তো খবরটা গেছে। খুব বেশি পরিবর্তন না হওয়ার কারণেই আসলে সেটাতে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ হয়নি’, বলেন তিনি।
আইইডিসিআরকে বিষয়টি জানানো উচিত ছিল কি না, জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আইইডিসিআরে জিনোম সিকোয়েন্সের সার্ভেইল্যান্স নিয়মিত করার সিদ্ধান্ত হচ্ছে। এখন বিজ্ঞানীদের গবেষণার জন্য সেটা আমরা করছি। কিন্তু, ইংল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ তো নিয়মিতভাবে জিনোম সিকোয়েন্স করে। যদি আমরা সার্ভেইল্যান্স করতাম, তাহলে তাদের (বিসিএসআইআর) বিষয়টি আইইডিসিআরে জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকত। এমনিতে বিজ্ঞানীরা একে অপরের সঙ্গে এগুলো শেয়ার করে থাকেন। আমি জানি না আইইডিসিআরের এই সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বিষয়টি জানতেন কি না। জানলেও যেহেতু তেমন বড় একটা পরিবর্তন হয়নি, তাই হয়তো এটা বিজ্ঞানীদের অভ্যন্তরেই থেকে গেছে।’
আরও পড়ুন:
নতুন স্ট্রেইনের কাছাকাছি ভাইরাস দেশে আগে থেকেই আছে: বিসিএসআইআর
করোনার নতুন স্ট্রেইন: করছি কী, করণীয় কী
যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন স্ট্রেইন ‘আরও দ্রুত ছড়ায়’, বড়দিনে কঠোর সতর্কতা
করোনার নতুন স্ট্রেইন মোকাবিলায় ভারতের কর্ণাটকে নাইট কারফিউ
Comments