উপেক্ষা নয়, তদন্তেই হোক সমাধান
নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। তবে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই জনমনের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রশ্নকারী নাগরিকদের উপেক্ষা করা, এড়িয়ে যাওয়া কিংবা তাদের বিষয়ে সম্মানহানিকর বক্তব্যে জনসাধারণের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। তাদের মনে হতে থাকে, নিশ্চয়ই কিছু আড়াল করার চেষ্টা চলছে। এমন কোনো কিছুই নির্বাচন কমিশনের জন্য ভালো না এবং অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্যও ভালো না।
জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে নির্বাচন কমিশন। এর মাধ্যমেই জনগণের ‘প্রত্যাশা’ দৃশ্যমান হয়, জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন, গণতন্ত্রের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান সংসদ গঠিত হয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের শাসন নিশ্চিত হয়, একটি নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়, জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে, জনগণের দাবি গুরুত্ব পায়, শান্তিপূর্ণভাবে এক রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে অপর রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা স্থানান্তর হয়। এক কথায় গণতন্ত্রের সব কিছুই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈধতা অর্জন করে। এই নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করার জন্য দায়বদ্ধ কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের যেকোনো ত্রুটি উপরের পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ- ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে দেখাবে।
এ কারণেই আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে এতটা গৌরবের জায়গা দিয়েছে এবং বাহ্যিক সব প্রভাবের বাইরে রেখেছে। এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যাকে নির্বাচন চলাকালীন সার্বিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের পদ সুরক্ষিত। সুপ্রিম কোর্টের বিচারককে অপসারণের জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়, সেই প্রক্রিয়াতেই কেবল তাদেরকে পদ থেকে সরানো যায়। এর সবই করা হয়েছে একটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করার জন্য।
নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব অপরিসীম। একইসঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, নির্বাচন কমিশনকে জনগণের চোখে সর্বোচ্চ স্তরের বিশ্বস্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায়বিচার শুধু নিশ্চিত করলেই হয় না, তা দৃশ্যমানও হতে হয়। তেমনি নির্বাচন কমিশনকেও শুধু সর্বোচ্চ নিষ্ঠা নিশ্চিত করলেই হবে না, বরং জনগণের দাবির ভিত্তিতে তদন্ত ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে তা প্রমাণ করা দরকার। বিশেষ করে আর্থিক দিক থেকে। একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনার পূর্বশর্ত হচ্ছে জনসাধারণের আস্থা অর্জন করা এবং তা বজায় রাখা। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার মাধ্যমেই সেই আস্থা অর্জন ও বজায় রাখা সম্ভব।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সম্প্রতি আবেদন করেছেন কয়েকজন সম্মানিত নাগরিক। এই আবেদনের গুরুত্ব বোঝার জন্য এবং উপলব্ধি করার জন্য উপরের ভূমিকার প্রয়োজন হলো। ৪২ জন নাগরিকের মধ্যে (একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বা আকবর আলি খান আমাদের জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত) অধ্যাপক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, শিক্ষাবিদ, প্রবীণ অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, ব্যাংকার, চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির কাছে একটি আবেদন করেছেন। গণতান্ত্রিক দেশের করদাতা নাগরিক এবং ভোটাররা আবেদন করেছেন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল (এসজেসি) গঠন করার জন্য।
কেন এসজেসি? কারণ, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় পুলিশ, অন্য কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারে না। এই আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে কেন? কারণ, কেবলমাত্র তিনিই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ দুটি আলাদা ক্যাটাগরির। একটি নির্বাচন সম্পর্কিত এবং অপরটি দুর্নীতি সম্পর্কিত।
নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী সত্যিই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে কি না, সেখানে সব নীতিমালা যথাযথভাবে মেনে চলা হয়েছে কি না, সকল দলের গুরুত্ব সমান প্রমাণে তাদের সব অভিযোগ বিবেচনায় নেওয়া এবং তা তদন্ত করা হয়েছে কি না, নির্বাচন পরবর্তী সব দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে কি না এসব বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং তদন্ত করা প্রয়োজন হয়।
এই বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুব বেশি ভিন্ন হওয়া উচিত না। কারণ অভিযোগগুলো নিছক মতামতের ভিত্তিতে করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দেখেই এসব অভিযোগের সমাধান করা যেতে পারে। আমরা দুর্নীতির অভিযোগের ওপর নজর রাখতে চাই। নজীর তৈরি এবং নির্বাচন কমিশনের যেটুকু বিশ্বাসযোগ্যতা বাকি আছে, তা বজায় রাখার জন্য এই তদন্ত করা প্রয়োজন।
অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা জাতীয় নির্বাচনের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এবং ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তব্য দিতে নিজেরাই নিজেদেরকে প্রদান করেছেন দুই কোটি টাকা। এই অভিযোগে ভিত্তিতে আমাদের পাঁচটি প্রশ্ন।
প্রথমত, কারো কাছ থেকে, কোনো কাজের জন্য, কোনো পরিস্থিতিতে কোনো আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অনুমতি কি আইন তাদের দেয়? যদি তা না দিয়ে থাকে, তাহলে তারা স্পষ্টতই আইন লঙ্ঘন করছেন। যদি অনুমতি থেকে থাকে, তাহলে তা কতটুকু? সেই পরিমাণ থেকে বেশি নেওয়া হয়েছে কি? তাদের বেতন ও ভাতা সুনির্ধারিত রয়েছে এবং তা তাদের কাজের সব ক্ষেত্রের জন্যই নির্ধারিত। তাহলে এই অতিরিক্ত অর্থ কেন?
দ্বিতীয়ত, অর্থের পরিমাণ। যদি ‘বক্তৃতা বা প্রশিক্ষণ’ দেওয়ার ফি নেওয়ার বিধান থেকেও থাকে, সেটা কি কোটি টাকা হতে পারে? নির্বাচন কমিশনের এক বিশেষ কর্মকর্তা (একজন সরকারি চাকুরে) বক্তৃতা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ফি হিসেবে ৪৭ লাখ টাকা নিয়েছেন।
তৃতীয়ত, তারা নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছেন, তাদের সঠিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করেছেন। এটি কি তাদের কাজেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়? তাহলে এই অতিরিক্ত অর্থ কেন?
চতুর্থত, ১৮ দিনে তাদের ৫২০ জায়গায় বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। প্রতিটি জায়গায় বেশ কয়েকজন নির্বাচন কমিশনারের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। এত স্বল্প সময়ে এতগুলো জায়গায় তাদের অবস্থান করা অসম্ভব বলেই মনে হয়। নির্বাচন কমিশনের নথি অনুযায়ী, এই পরিদর্শনগুলো আসলে হয়নি। তাহলে কী হয়েছে? এটা ভুয়া বিল করার ঘটনা কি না তা জানতে চাওয়া কি অপরাধ?
সর্বশেষ, নির্বাচনে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তার সবগুলোর কি অডিট হয়নি? জনগণের অর্থ ব্যয় করে তার অডিট করা কি বাধ্যতামূলক নয়? নির্বাচন কমিশনের অ্যাকাউন্ট কি অডিট ছাড়া থাকতে পারে?
দুর্নীতির আরেক গুচ্ছ অভিযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশনেরই একজন সদস্যের কাছ থেকে। অভিযোগটি চার কোটি টাকা ব্যয়ে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে। এই নির্বাচন কমিশনার নিজের সুনাম ও সততা থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিতসহ লিখিত অভিযোগ জানান। তার অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা এবং একটি স্বাধীন তদন্তের দাবি রাখে। বিশ্বের যেকোনো দেশের মিডিয়াসহ বিভিন্ন স্তরে এই অভিযোগটি বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব পেত।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কয়েকজন নির্বাচন কমিশনারের নামে অফিসিয়াল গাড়ির অপব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগটি হলো- দুটি গাড়ি পাওয়ার কথা থাকলেও তারা তিনটি গাড়ি ব্যবহার করছেন বা করেছেন। কেন তাদের তিনটি গাড়ি দরকার? নির্বাচন কমিশনের লগ বইগুলোতে এই প্রয়োজন কীভাবে দেখানো হয়েছে? এগুলো এমন প্রশ্ন, যা ইচ্ছা থাকলে খুব সহজেই যাচাই করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা করেন। যাদের কারো কোনো স্বায়ত্তশাসন নেই। ফলে তদন্তগুলো সবসময়ই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেষ হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে ৪২ জন নাগরিকের করা আবেদনেরও একই অবস্থা হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ রয়েছে। তবে এটা উচিত হবে না। নির্বাচন কমিশন সরকারের কোনো অংশ নয়। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের দায় সরাসরি সরকারের উপর পড়ে না। তবে নেতা-মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়ায় জনমনে ধারণা হতে পারে যে, দায় সরকারের। নির্বাচন কমিশনের প্রতি প্রশ্ন উঠলেই তা এই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও, তা সরকারের চিন্তার কারণ হওয়া উচিত না।
যে বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে শেষ করতে চাই তা হলো— এই পর্যায়ে আমরা দুর্নীতির ‘অভিযোগ’ বলছি, ‘প্রমাণ’ নয়। এই পার্থক্যটি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তদন্ত ছাড়া কোনোভাবেই কাউকে দোষী বলতে চাই না। তবে অভিযোগগুলো গুরুতর এবং বেশিরভাগই নির্বাচন কমিশনের নথিপত্রের ভিত্তিতে উত্থাপিত। লোক দেখানো নয়, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমেই এই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এতে সত্য উন্মোচিত হবে এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আমাদের এমন দাবি কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে। এ জন্যই রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানানো।
পুরো জাতি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তিনি কি নাগরিকদের অভিযোগ শুনে তাদের সম্মানিত করবেন? নাকি দেশের বর্তমান সাধারণ ‘রীতি’র মতোই নাগরিকদের কণ্ঠ উপেক্ষা করবেন?
• ২৪ ডিসেম্বর ২০২০
(আজ শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত লেখার বাংলা অনুবাদ)
Comments