ক্রিকেটের ২০২০: উৎসবের আয়োজনে স্থবিরতার হাহাকার
সংখ্যায় বছরটা ছিল টোয়েন্টি-টোয়েন্টি। বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ, দ্বিপাক্ষিক সিরিজ মিলিয়ে ছিল টি-টোয়েন্টির মেলা। ছিল ওয়ানডে লিগেরও অনেক খেলা, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ঠাসা সূচি তো ছিলই। অথচ করোনাভাইরাসের হানায় ২০২০ হয়ে গেছে বিষময় বিশ।
আর সব কিছুর মতো ক্রিকেটের জন্যও বছরটা দুঃসংবাদে ভরপুর, অতিমারির শ্রান্তিতে কাবু।
মার্চে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে যখন ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজে ব্যস্ত বাংলাদেশ, তখনো করোনা এমন রূপ নেবে সেই আঁচ মেলেনি। কিন্তু দ্রুতই বদলায় রঙ। ওই মাসেই শ্রীলঙ্কায় খেলতে এসেছিল ইংল্যান্ড, ভারত সফরে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। চলছিল অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ওয়ানডে সিরিজ। করোনা আচমকা দাপট দেখানোয় সিরিজ শুরুর আগেই দেশে ফিরে যায় ইংল্যান্ড।
ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের সিরিজ দর্শকশূন্য মাঠেও শেষ করা যায়নি। এরপরই শুরু একের পর এক খেলা স্থগিত কিংবা বাতিলের মিছিল। সেই তালিকা দীর্ঘ। সেই ফিরিস্তি টানাও ক্লান্তিকর।
বাংলাদেশের আক্ষেপ
এই বছরেই নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ১০ টেস্ট খেলার সূচি ছিল বাংলাদেশের। অথচ বছর শেষের অর্জন কেবল দুই টেস্ট। পাকিস্তানে গিয়ে ইনিংস ব্যবধানে হার, আর জিম্বাবুয়েকে ডেকে এনে ইনিংস ব্যবধানে হারানো। অম্ল-মধুর এই অল্প অভিজ্ঞতা দিয়ে পুরো বছরের লাভ-ক্ষতির খতিয়ান টানার অবস্থা নেই।
এই দশ টেস্টের মধ্যে বড় আক্ষেপ বোধহয় অস্ট্রেলিয়াকে ঘরের মাঠে না পাওয়া। স্টিভেন স্মিথদের বিপক্ষে কালেভদ্রে পাওয়া টেস্ট খেলার সুযোগ করোনার কারণে ভেস্তে যায়। শ্রীলঙ্কায় স্থগিত হওয়া তিন টেস্ট আগামী বছর আবার আয়োজনের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দুই টেস্ট ধরতে হবে হারানোর তালিকায়। পাকিস্তানে গিয়ে এক টেস্ট, নিউজিল্যান্ডের আসার কথা ছিল দুই টেস্ট খেলতে। তাও আর পুনর্বিন্যাস করা হবে কিনা বলার উপায় নেই।
বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপের মতো আসরগুলো পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। কিন্তু আয়ারল্যান্ড সিরিজসহ দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলো থাকছে আক্ষেপ হয়েই।
পুরো বছরে বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলেছে মাত্র তিনটি। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর এত কম ওয়ানডের বছর আর দেখেনি দেশের ক্রিকেট।
সবচেয়ে বেশি হাতছাড়া হয়েছে টি-টোয়েন্টি। অনেকগুলো দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সঙ্গে এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপ মিলিয়ে প্রচুর পরিমাণ টি-টোয়েন্টি ছিল বছর জুড়ে। যার অনেকগুলো পুনর্বিন্যাস করা হলেও বেশ কয়েকটি আবার বাতিলের খাতায়।
মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ছিল এই বছর। মেলবোর্নে ৮৬ হাজার দর্শক মাঠে বসে দেখেছিলেন ভারতকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম শিরোপা জয়। বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য বছরই ভুলে যাওয়ার মতোই। বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের সব ম্যাচ হারে সালমা খাতুনের দল। বছরের শেষ দিকে ভারতের উইমেন্স টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জ খেলতে সংযুক্ত আরব আমিরাত গিয়েছিলেন জাহানারা আলম আর সালমা। এটাকেও একটা অর্জন হিসেবে রাখতে পারে বাংলাদেশ।
যুবাদের বিশ্বজয়
ডিসেম্বরে এসে ফেব্রুয়ারির সেই সময়টা মনে হচ্ছে কোনো সুদূরের ঘটনা। অথচ এই বছরেই তো বাংলাদেশের ক্রিকেটে এসেছে কী দারুণ এক অর্জন! অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ নাম জুড়ে আছে এমন আসরে বাংলাদেশের কোনো দলের সেরা সাফল্য এটি। আকবর আলি, পারভেজ হোসেন ইমন, শরিফুল ইসলামরা রাতারাতি বনে যান তারকা। বিপুল উন্মাদনায় বাংলাদেশের মানুষ বরণ করে তাদের।
এই যুবারাই নিবেদন, উদ্যম, ইতিবাচক শরীরী ভাষায় জানান দেন আগামীর বাংলাদেশের নতুন আশাবাদের কথা। তাদেরকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করেছিল বিসিবি। করোনায় বাতিল হয় এই তরুণদের কয়েকটি বিদেশ সফরও।
বিদায় অধিনায়ক মাশরাফি
মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিলেটে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলছিল বাংলাদেশ। শেষ ওয়ানডের আগে আকস্মিকভাবে দেশের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা জানিয়ে দেন- খেলা চালিয়ে গেলেও অধিনায়কত্ব ছাড়ছেন তিনি। তার এই ঘোষণার পর আবেগের স্রোত বয়ে যায় দল জুড়ে। সতীর্থদের কাঁধে চেপে নায়কোচিত এক বিদায় পান মাশরাফি। ২০১৪ থেকে শুরু হওয়া যাত্রা, টানা দুই বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার গৌরবময় সময়ের হয় ইতি।
লকডাউনে রসালাপ
করোনা এবার ক্রিকেটারদের গৃহবন্দি করে স্বাভাবিক চলাচল যেমন বন্ধ করেছিল, তেমনি খুলে দিয়েছিল ভিন্ন এক দুয়ারও। ঘরবন্দি ক্রিকেটাররা অনলাইনের বিভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে অলস সময়টা প্রাণবন্ত করে তোলেন খোশগল্পে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় পাওয়া যায় ভারতীয় ক্রিকেটারদের। তাতে সামিল হন নানান দেশের ক্রিকেটারও। নিয়মিতই ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুকে লাইভ আড্ডা দিতে দেখা যায় তাদের।
তারকা ক্রিকেটাররা খেলা ও তাদের ব্যক্তিজীবনের নানান অজানা গল্প নিয়ে হাজির হন ভক্তদের সামনে। বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালও চালু করেন অনলাইন আলাপন। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, কেন উইলিয়ামসনদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা যায় তাকে। মাশরাফি, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদসহ দেশীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গেও জমে উঠে তার অনলাইন আড্ডা। এতে বের হয়ে আসে অনেক গল্প। পাওয়া যায় সংবাদের অনেক খোরাক।
১১৭ দিন পর ফেরা
৮ জুলাই দিনটিকে আলাদা করে মনে রাখবে ক্রিকেট। ১১৭ দিনের স্থবিরতা কাটিয়ে সেদিনই সাউদাম্পটনে টেস্ট খেলতে নেমেছিল ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পরিস্থিতির দাবিতেই নেহায়েত একটা সাধারণ সিরিজ পেয়ে যায় বিশাল ফোকাস।
তবে ফেরাটা ছিল একেবারেই ভিন্নভাবে। ‘জৈব সুরক্ষা বলয়’ বা ‘বায়ো সিকিউর বাবল’ তখন থেকেই হয়ে যায় নতুন টার্ম। স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়িতে বেশ অনেকগুলো নিয়ম বেঁধে দেয় ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড, সহযোগিতায় এগিয়ে আসে আইসিসি। হোম আম্পায়ার, করোনা পরীক্ষা, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, বলে লালা ব্যবহারে বিধি নিষেধ, উদযাপনের ধরন বদল। অনেক নতুন কিছুর মেলে দেখা। দুই ভেন্যু সাউদাম্পটনের রোজ বৌল আর ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্র্যার্ফোডে ছিল প্যাভিলিয়নের মধ্যেই আবাসিক হোটেলের সুবিধা। তাতে ক্রিকেট ফেরানো সহজ হয় ইংল্যান্ডের।
এই সুবিধা নিয়েই পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়াকেও আতিথেয়তা দেয় ইংল্যান্ড। তাদের দেখানো পথে দর্শক রেখেই ক্রিকেট ফিরেছে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায়। নিজ দেশে ক্রিকেট ফিরিয়েছে পাকিস্তান। দক্ষিণ আফ্রিকাও হেঁটেছে একই পথে। এপ্রিলে স্থগিত হলেও পরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিয়ে গিয়ে জমজমাট আইপিএল আয়োজন করে ভারত। অবশ্য সবার আগে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট সিপিএল আয়োজন করে দেখায় উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড।
নতুন বাস্তবতা গায়ে মেখে স্বাভাবিক হতে শুরু করে সব দেশের ক্রিকেটই। প্রেসিডেন্ট’স কাপের প্রস্তুতিমূলক ওয়ানডে টুর্নামেন্টের পর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি দিয়ে মাঠের খেলা ফিরে বাংলাদেশেও। যদিও বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটে ফেরা হতে হতেও হয়নি এই বছরে আর।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সাকিবের ফেরা
জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করে ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর সব ধরনের ক্রিকেটে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল সাকিব আল হাসান। এই বছর অবধারিতভাবেই ফেরেন তিনি। নিষেধাজ্ঞার সময়টায় অনেক ম্যাচ হারানোর সামনে ছিলেন সাকিব। কিন্তু করোনা এক অর্থে তাকে দিয়েছে স্বস্তি। তিনি নিষিদ্ধ থাকাকালে করোনায় বেশিরভাগ সময় বন্ধ ছিল সারাদুনিয়ার খেলাই। ফেরার পর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে খেলেছেন ওয়ানডের শীর্ষ অলরাউন্ডার। বোলিংয়ে কিছু নৈপুণ্য দেখালেও আট ম্যাচ খেলে নিষ্প্রভ ছিলেন ব্যাট হাতে। ফেরার পর কোয়ারেন্টিনের নিয়ম না মানা, কলকাতায় এক পূজার উদ্বোধনে গিয়ে উগ্রবাদীদের হুমকি পাওয়ার পর উলটো তা অস্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ায় চরম বিতর্কিত ও সমালোচিতও হন এই তারকা।
রেকর্ডের আলোয় ২০২০
খেলা হয়েছে কম। আহামরি কোনো রেকর্ডের সুযোগও ছিল সীমিত। তবে স্মরণীয় কিছু ঘটনা তবু ঘটেছে এই বছরে।
মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ১৭৬ রানের ইনিংস খেলেন লিটন দাস। ওই সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই নিজের আগের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন তামিম। এক ম্যাচের ব্যবধানেই তা কেড়ে নেন লিটন। এই বছরেই বিসিএলের ম্যাচে অপরাজিত ৩৩৪ রান করে তামিম প্রথম শ্রেণিতে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের হয়ে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড স্পর্শ করেন ৫০০ উইকেটের মাইলফলক। পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের সিরিজে প্রথম পেসার হিসেবে টেস্টে ৬০০ উইকেটের অনন্য চূড়ায় উঠেন জেমস অ্যান্ডারসন।
বছরের শেষ দিকে এসে এক বিব্রতকর রেকর্ড সঙ্গী হয় ভারতের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাডিলেড টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তারা গুটিয়ে যায় মাত্র ৩৬ রানে। টেস্ট ইতিহাসে এর আগে এত কম রানে অলআউট হয়নি ভারত। এই টেস্টেই ৯৬ বছর পর দেখা মিলে আরেক রেকর্ডের। কোনো একটি দলের টেস্ট ইনিংসে কোনো ব্যাটসম্যানই করতে পারেননি দুই অঙ্কের রান!
আরও যা আলোচিত
গত বিশ্বকাপের পর ভারতীয় দলে আর দেখা মিলছিল না মহেন্দ্র সিং ধোনির। আবার অবসরও নিচ্ছিলেন না তিনি। করোনার সময় কাটিয়েছেন নিজের বাংলো বাড়িতে। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে রেখেছেন আড়াল। নিভৃতবাসের মধ্যে আচমকা একদিন টুইট করে এক হিন্দি গান জুড়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন ভারতের সফলতম অধিনায়ক। পরে আইপিএলেও ব্যর্থতা সঙ্গী হয় তার।
Comments