বইয়ের আলো ছড়ানো অদম্য এক তরুণের গল্প

যখন অধিকাংশ মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়েও কেউ কেউ সমাজে জন্মায় পরের জন্য। কাজ করে যায় আপন আলোয় সামাজিক মুক্তির জন্য। এটাই কারো কারো সারাজীবনের ব্রত। মামুন তেমনি একজন। উত্তরবঙ্গের উত্তম আলো হয়ে সমাজ আলোকিত করে যাচ্ছেন প্রায় এক দশক ধরে। তার পরো নাম মাহমুদুল ইসলাম মামুন। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। বাবা মৃত আজহারুল ইসলাম, মা মাহমুদা বেগম। রংপুরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন মামুন।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই ও গাছের চারা দেন মামুন।

যখন অধিকাংশ মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়েও কেউ কেউ সমাজে জন্মায় পরের জন্য। কাজ করে যায় আপন আলোয় সামাজিক মুক্তির জন্য। এটাই কারো কারো সারাজীবনের ব্রত। মামুন তেমনি একজন। উত্তরবঙ্গের উত্তম আলো হয়ে সমাজ আলোকিত করে যাচ্ছেন প্রায় এক দশক ধরে। তার পরো নাম মাহমুদুল ইসলাম মামুন। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। বাবা মৃত আজহারুল ইসলাম, মা মাহমুদা বেগম। রংপুরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন মামুন।

এক সময় রাজশাহীর পলান সরকার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে পাঠক সৃষ্টি করেছেন। তার থেকে একধাপ এগিয়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার মামুন নামে এক অদম্য স্বপ্নবাজ তরুণ।

তার নেশা বিনামূল্যে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পড়ানো। এ ছাড়াও, নদীভাঙন, নদী দূষণ ও দখল নিয়ে কাজ করেন, সচেতন করেন সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে। সেই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় অবিরত ছুটে চলা তো আছেই। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে— মামুন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে সকাল-বিকেল উপহার হিসেবে পৌঁছে দেন গাছের চারা। মনের আনন্দে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গাছ লাগান। শুধু তাই নয়, এসবের সঠিক পরিচর্যা হয় কি না, সে খেয়ালও রাখেন। পাড়া-প্রতিবেশীরাও বলেন, এটা মামুনের রুটিনমাফিক প্রতিদিনের কাজ। সবাই দেখে সাইকেলে করে গাছের চারা নিয়ে চলে যান নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায়ও। সবার কাছেই মামুন পরিচিত মুখ। সবাই তাকে বই-বৃক্ষবন্ধু হিসেবে চেনেন, জানেন।

নিজ গ্রামসহ মোট ১৭টি গ্রামে কয়েক হাজার বিভিন্ন ধরেনর গাছ লাগিয়েছেন বা বিতরণ করেছেন মামুন। তা ছাড়া, নিজের প্রয়োজনে যখন যে শহরে যান, সে শহরেই গাছ লাগিয়ে আসেন মামুন। ছোটবেলা থেকেই গাছ বিতরণ করতেন। তবে, ২০১৩ সাল থেকে নিয়মিত গাছের চারা বিতরণ করেন এবং মানুষকে বই পড়ে শোনান। মামুনের মা মাহমুদা বেগম বলেন, ‘সাধারণ মানুষের সঙ্গে সময় কাটিয়ে সে ভালো থাকে, আনন্দ পায়। এমনও হয়েছে, ওর নিজের ওষুধ কেনার টাকা দিয়ে গাছ কিনে ফেলেছে। ঈদের পাঞ্জাবি না কিনে বই কিনে পড়ছে আর মানুষকে পড়ে শোনাচ্ছে। অল্প কিছু হাঁস-মুরগি পালন করে সে। এটা থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে প্রতিদিন গাছ বিতরণ করে। তার কোনো চাহিদা নেই, সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।’

বই পড়ে শোনাচ্ছেন মামুন।

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক পলিথিন ব্যবহারের বিষয়েও মানুষকে সচেতন করেন মামুন। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর দ্রব্যগুলো আলাদা করে রাখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করেছেন ডাস্টবিন। বস্তা দিয়ে তৈরি সেসব ডাস্টবিনের গায়ে লেখা ‘এসো, মাটি দূষণরোধে পলিথিন বর্জন করি। ব্যবহৃত প্লাস্টিক সংরক্ষণ করি। প্লাস্টিক গাছ, জমি ও ফসলের ক্ষতি করে।’ এলাকার মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা পলিথিন আর প্লাস্টিক এখন এসব ডাস্টবিনে ফেলছে। মামুন বলেন, ‘এইভাবেই শুরু হয়েছে পরিবর্তনের।’ শিশুদের থেকে বয়স্ক মানুষ— সবার কাছেই মামুন খুব প্রিয়। গাছের চারা বিতরণ, বই পড়ে শোনানো, পরিবেশ রক্ষায় মানুষকে বোঝানো— এসব কাজেই কেটে যায় মামুনের সময়।

সাংবাদিক ও নাট্যকার সরকার হায়দার বলেন, ‘মামুন এই অঞ্চলে যা করছে, তা অতুলনীয়। তাকে নিয়ে অনুভূতি অসামান্য। কোনো সরকার প্রতিনিধি বছরের পর বছর যা পারেনি, মামুন একাই তা করে চলছেন। তরুণদের মধ্যে দৃষ্টান্ত।’

মামুনের কাজ ও কীর্তি কেবলমাত্র এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। প্রসঙ্গত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘মামুন নিয়ে আমার অনেক কথা, বিশেষ করে তার চিন্তা আমার কাছে দিক দর্শন মনে হয়। আমি শুরু থেকেই তার সঙ্গে আছি, থাকব। তৃণমূল থেকে বই পড়ায়, গাছ লাগায়, নদী দূষণ নিয়ে কথা বলে, সর্বোপরি এসব কাজ দেশপ্রেমের মূল্যবোধ তৈরি করে। দেশকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। একটা রাষ্ট্র, একটা দেশ কেবলমাত্র সরকার এগিয়ে নেয় না, মামুনরাও নেয়। তাদের পাশে থাকুন দেশবাসী। অনুপ্রেরণা দিন। জেলা-উপজেলায় মামুন তৈরি হোক। মনে রাখবেন, মামুনরাই সমাজ ও মূল্যবোধ তৈরি করে।’

মানুষের ভালোবাসায় মামুন প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাড়ির আঙিনায় বসে বই পড়ে শোনান। শিশু, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষকে নিয়ে বই পাঠের আসর করেন। সেখানে পরিবেশ বাঁচাতে বৃক্ষ রোপণের কথা বলেন। সবাইকে বেশি করে গাছ লাগাতে উৎসাহ দেন। নিজে গাছের চারা উপহার দিয়ে আসেন।

কোনো স্বীকৃতি না পেলেও গত বছর প্রথম আলোতে ফিচার প্রকাশিত হলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মামুনকে এক লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। যা দিয়ে মামুন বই কিনেছেন বলে জানিয়েছেন। মামুন চান, আরও অনেক তরুণ এসব কাজে এগিয়ে আসুক। তাহলেই সামাজিক মুক্তি ঘটবে।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago