প্রবাসে

কাতারে আসার আগে করণীয় ও বর্জনীয়

স্টার ফাইল ফটো

মানবজাতির অভিবাসনের ইতিহাস প্রায় ১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন বছরের পুরানো। বিপরীতে ‘টেকসই’ শব্দের উৎপত্তি ও ব্যবহারের ইতিহাস সাম্প্রতিক। শব্দটি অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে স্থান পায় বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এবং সত্তর-এর দশকে টেকসই উন্নয়ন শব্দটি সংজ্ঞায়িত হয়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যের কয়েকটি টেকসই অভিবাসন নিশ্চিত করার সাথে সম্পর্কিত। আজকের আলোচনা টেকসই অভিবাসনের রূপরেখা, উপযোগিতা এবং টেকসই অভিবাসন নিশ্চিত করা নিয়ে।

বিশ্বে অনেক দেশের জন্যই অভিবাসন উন্নয়নের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিদেশে কর্মসংস্থান শুধুমাত্র কর্মী প্রেরণকারী দেশের বেকারত্ব হ্রাসই করে না একই সাথে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে। তাই টেকসই অভিবাসনের কোন বিকল্প নেই।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অভিবাসন একটি চলমান প্রক্রিয়া। গন্তব্য দেশগুলি উৎস দেশ থেকে চাহিদা অনুযায়ী কর্মী সংগ্রহ বা নিয়োগ দিয়ে থাকে। গন্তব্য দেশের চাহিদা ও উৎস দেশের যোগান অনুযায়ী অভিবাসন প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহমান থাকাকে টেকসই অভিবাসন বলা যেতে পারে।

তবে এই প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্থ হতে পারে বিভিন্ন কারণে। প্রথমত কর্মীদের গন্তব্য দেশে যদি দেশভিত্তিক কোটা ব্যবস্থা রাখে ও কর্মী প্রেরণকারী দেশ যদি ইতোমধ্যে কোটা পূরণ করে থাকে এবং সে প্রেক্ষিতে গন্তব্যদেশ যদি কর্মী নিয়োগ না করে।

দ্বিতীয়ত গন্তব্য দেশ যদি নিজ দেশের কর্মী নিয়োগের জন্য কিছু বিশেষ সেক্টরে অভিবাসী কর্মী নিয়োগ নিষিদ্ধ করে।

তৃতীয়ত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির কারণে যদি অভিবাসন বন্ধ থাকে।

চতুর্থত কর্মীদের ক্রমাগত বেআইনি কার্যকলাপের কারণে গন্তব্য দেশ যদি নিজ দেশের কর্মী নিয়োগের জন্য কিছু বিশেষ সেক্টরে অভিবাসী কর্মী নিয়োগ নিষিদ্ধ করে।

প্রথম কারণের ক্ষেত্রে কাতারকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে। কাতার সরকার যে কোন দেশের জন্য নির্ধারিত কোটা সর্বোচ্চ পূরণ করছে। কিন্তু এসব দেশ থেকে কর্মী নিয়োগ হ্রাস পেলেও বন্ধ হয়নি। উপরন্তু শ্রম বাজার বহুমুখীকরণের মাধ্যমে উৎস দেশগুলো গন্তব্য দেশে কর্মীদের অভিবাসন অব্যাহত রাখতে পারে।

যেমন, বর্তমানে কাতারে প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করছে, যাদের প্রায় ৮০ ভাগ নির্মাণ শ্রমিক। ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২ উপলক্ষ্যে কাতারে চলমান ব্যাপক নিমার্ণ কাজ এই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির দেশটিতে অভিবাসন সম্ভব করেছে। বর্তমানে অধিকাংশ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় স্বল্পদক্ষ নির্মাণ শ্রমিকের চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পেয়েছে। তাই কাতার বাংলাদেশকে দক্ষ শ্রমিকের অভিবাসনের উপর গুরুত্বরোপ করেছে। অর্থাৎ শ্রমবাজার ডাইভারসিফিকেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কাতারে অভিবাসন অব্যাহত রাখতে পারে।

দ্বিতীয় কারণের ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। সৌদি আরব কিছু সেক্টরে বিভিন্ন সময়ের মধ্যে অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। অর্থাৎ সব সেক্টরে বিদেশি কর্মী নিয়োগ করা হবে না। এর উদ্দেশ্য হলো ওই সমস্ত সেক্টরে গন্তব্য দেশের নিজেদের নাগরিকদের নিয়োগের সুযোগ তৈরি করা।

তৃতীয় কারণটির অন্যতম উদাহরণ হলো কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের কারণে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশরের সাথে কাতারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি এবং সেহেতু কর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকা। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অবনতি হওয়ায় বর্তমানে এসব দেশ থেকে কাতারে অভিবাসন বন্ধ আছে। আশা করা হচ্ছে এ সমস্যাটির সমাধান খুব তাড়াতাড়ি হবে।

চতুর্থ কারণটির বিভিন্ন উদাহরণ বিদ্যমান থাকলেও শ্রমবাজার বন্ধের কারণ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গন্তব্যদেশ কর্তৃক কর্মীদের বেআইনি কার্যকলাপকে দায়ী না করায় কোন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন সম্ভব হয়নি।

তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, টেকসই অভিবাসনের ক্ষেত্রে চতুর্থ কারণটি একটি বড় বাধা। কোন উৎস দেশের অভিবাসীদের আচরণের কারণে গন্তব্য দেশে অভিবাসন বন্ধ হলে টেকসই অভিবাসন নিশ্চিত হয় না। টেকসই অভিবাসন নিশ্চিত করার জন্য গন্তব্য ও উৎস উভয় দেশেরই দায় দায়িত্ব রয়েছে এবং এক্ষেত্রে উৎস দেশের দায় দায়িত্ব বেশি।

২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন অভিবাসন নিয়ে ৮টি উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তার পঞ্চম পরিকল্পনাটি ছিল, গন্তব্য দেশে অভিবাসী কর্মীদের সম্পর্কে ভাল ধারণা সৃষ্টি করা। এজন্য অবশ্যই অভিবাসী কর্মীদের গন্তব্য দেশের প্রচলিত নিয়ম কানুন মেনে চলাসহ বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এজন্য প্রধান কাজ হলো কর্মী প্রেরণকারী দেশে কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। এই কাজটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী। তাই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। কাতারে বাংলাদেশ দূতাবাস একটি সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, যা নমুনা হিসেবে এখানে উপস্থাপন করা হলো।

কাতারে আপনার করণীয় বিষয়গুলো

কাতারে আসার আগে কাতার ভিসা সেন্টার থেকে মেডিকেল চেক-আপ, হাতের ছাপ, চাকরির চুক্তিপত্রে সই সম্পন্ন করা। সইয়ের সময় বেতন এবং অন্যান্য শর্তাদি ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করা।

দেশ থেকে কোনো ওষুধ বহন করার সময় অবশ্যই রেজিস্টার্ড ডাক্তারের সিল ও সইযুক্ত প্রেসক্রিপশন সাথে রাখা। অন্যথায়, কাতারের আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।

কাতারের প্রচলিত আইন-কানুন, ঐতিহ্য, সামাজিক প্রথা মেনে চলা।

নিয়োগকারীর সাথে সম্পাদিত শ্রম চুক্তির একটি কপি সবসময় নিজের কাছে রাখা।

চুক্তি মোতাবেক নিজের অধিকার, প্রাপ্যতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা

নিজ পাসপোর্ট নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণে রাখা ও কাতারি আইডি সবসময় নিজের সাথে রাখা।

শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দাফনাস্থ লেবার ডিপার্টমেন্ট (আল হুদা টাওয়ার) অথবা লেবার কোটে (সানাইয়া-১৩) অভিযোগ দাখিল করা।

রাস্তাঘাট ও আবাসস্থল পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।

পথচারী পারাপারের ক্ষেত্রে আশপাশে গাড়ি আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে সতর্কতার সাথে নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে রাস্তা পার হওয়া।

বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত প্রেরিত রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা সুবিধা নেওয়া।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সুবিধাদি প্রাপ্তির জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সদস্যপদ গ্রহণ করা।

সমস্ত আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ রাখা।

কাতারে বর্জনীয় বিষয়গুলো

কোম্পানিতে কাজ আছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে নিজে কাতারে না আসা বা আত্মীয়-স্বজনসহ অন্যকে না আনা।

বাংলাদেশ থেকে কাতারে আসার সময় ভালো করে না জেনে কোনভাবেই অন্যের দেয়া কোন মালামাল বহন না করা।

ভাল করে না পড়ে বা না বুঝে কোন কাগজে সই না করা।

কাতারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রশাসনিক উন্নয়ন, শ্রম ও সামাজিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় বা আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ব্যতিত নিয়োগকর্তা ছাড়া অন্য কারো অধীনে কাজ না করা।

ভিসা ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে কোনোভাবেই নিজেকে সম্পৃক্ত না করা।

মাদকদ্রব্য বহন, সেবন ও বিক্রি না করা। নিজ আবাসস্থলে অন্য কাউকে মাদকদ্রব্য সংরক্ষণ করতে না দেয়া।

জুয়া না খেলা এবং জুয়ার আসর থেকে নিজেকে দূরে রাখা।

জালিয়াতি, আমানতের খেয়ানত, চুরি ইত্যাদি গর্হিত ও বেআইনি কাজে নিজেকে না জড়ানো।

ইন্টারনেট, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কাতারের প্রচলিত আইন লঙ্ঘন না করা।

প্রচারণা পদ্ধতি

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অভিবাসী কর্মীদের অভিবাসনের পূর্বে ব্রিফিং ও ওরিয়েন্টেশনে প্রোগ্রামের মাধ্যমে কর্মীদের সচেতন করে থাকে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাও কর্মীদের সচেতন করার কাজ করে থাকে। গর্ভন্যান্স তত্ত্বে আধুনিক শাসন পদ্ধতি হলো সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বের সমন্বয়। তাই বেসরকারি খাতের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।

এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন করার কাজ করতে হবে। কাতারে প্রচারিত বিষয়গুলো সংশোধন করে সব দেশের জন্য প্রয়োগ হতে পারে এমন একটি প্রচারপত্র তৈরি করা যেতে পারে এবং তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হলে জেলা, উপজেলা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে প্রচারণামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রত্যেক প্রশাসনিক অঞ্চলে কর্মরত এনজিওকে তাদের গ্রাহকদের মধ্যে প্রচারণামূলক কার্যক্রম চালানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম চালানো যেতে পারে যদি তা ধর্মীয় বিধি বিধানের পরিপন্থী না হয়। খুৎবার সময় এসব নিয়ে বক্তব্য দেওয়া কিংবা মসজিদে মাইকের মাধ্যমে জনগণকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে।

অভিবাসী কর্মীদের ক্ষেত্রে নিজ নিজ দূতাবাসে, বিমানবন্দরে এসব প্রচারপত্রের কপি রাখা যেতে পারে এবং অভিবাসীকর্মীদের হাতে তুলে দেয়া যেতে পারে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চুক্তি অনুযায়ী আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধাদি না পাওয়া অথবা বিলম্বে পাওয়া ইত্যাদি নিয়ে অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ থাকতে পারে। কিন্তু এসব বিরোধ নিষ্পত্তির আইনানুগ পন্থা আছে। বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই আইনানুগ পন্থা অবলম্বন করা উচিত।

লেখক: ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, কাউন্সেলর (শ্রম), বাংলাদেশ দূতাবাস, দোহা, কাতার।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago