‘মুক্তির প্রতীক’ ম্যারাডোনা
২০২০ সালে অনেকগুলো দুঃসংবাদের মধ্যে অন্যতম ডিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যু। গত ২৫ নভেম্বর কিংবদন্তি এই ফুটবল খেলোয়াড় ৬০ বছর বয়সে আর্জেন্টিনায় নিজ বাড়িতে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
ম্যারাডোনা কেবলমাত্র সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে নন, একইসঙ্গে তার বিদ্রোহী চেতনার কারণেও তিনি লাখো ভক্তের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
আলজাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে স্পেনের পম্পেউ ফাবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক স্যানটিয়াগো জাবালা বলেন, ‘ম্যারাডোনা ছিলেন আদতে একজন বিপ্লবী। তিনি ফুটবলকে মাঠের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা রাজনৈতিক রূপ দিয়েছিলেন। তিনি লাখ লাখ দরিদ্র ও প্রান্তিক ভক্তদের মুক্তির আশা দেখিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে শুধু দক্ষতা দিয়ে তেমন কোনো স্থায়ী পরিবর্তন আনা যায় না। এজন্য প্রয়োজন সাহস, বিবেক ও সহনশীলতা।’
ম্যারাডোনা বুয়েনস এইরেসের দক্ষিণ উপকণ্ঠে অবস্থিত ভ্যান ফিওরিটো শহরে জন্মছিলেন। তার বাবা-মা দেশের উত্তর-পূর্বে কোরিয়েন্তেস প্রদেশ থেকে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। কোনোমতে একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন তারা। বাসায় পানি কিংবা বিদ্যুৎ ছিল না।
ফিওরিটো শহরেই বেড়ে ওঠেন ম্যারাডোনা। নিজের জন্মস্থান নিয়ে ভীষণ গর্ব ছিল তার।
মাত্র ১১ বছর বয়সেই আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স ক্লাব লস সেবোলিটাসে ম্যারাডোনার প্রতিভা বেরিয়ে আসে।
কয়েক বছর জনপ্রিয় বুয়েনস এইরেসের দল বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেলার পরে ১৯৮২ সালে ইউরোপে চলে যান ম্যারাডোনা। সেখানে অভিজাত দলগুলোর হয়ে খেলতে শুরু করেন তিনি। তার প্রথম দল ছিল এফসি বার্সেলোনা। ইনজুরি ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকানদের প্রতি তীব্র বর্ণবাদের কারণে সেখানে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ম্যারাডোনা।
এই কারণেই ১৯৮৪ সালে তিনি পশ্চিম ইউরোপের অন্যতম দরিদ্রতম শহর ইতালির নেপলসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। খুব দ্রুতই তিনি নেপলি সতীর্থ ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে যান।
ইতালির সমৃদ্ধ উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা সবসময় দরিদ্র ও স্বল্প উন্নত দক্ষিণাঞ্চলকে খাটো চোখে দেখতো। দক্ষিণের বাসিন্দাদের প্রায়শই উত্তরের জনগণ ‘ইতালির আফ্রিকান’ বলে সম্বোধন করতো। খেলার মাঠেও দুই অঞ্চলের মধ্যে বেশ উত্তেজনা চলে।
ইতালীয় ফুটবল লিগে উত্তরের প্রতিষ্ঠিত আধিপত্য ভেঙে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। তিনি ১৯৮৫ সালে নেপোলিকে তার প্রথম খেতাব জিতিয়েছিলেন।
লা রেপব্লিকা পত্রিকায় ইতালিয়ান লেখক রবার্তো সাভিয়ানো এক নিবন্ধে লেখেন, ‘ম্যারাডোনা ছিল একটি মুক্তির প্রতীক। হ্যাঁ, মুক্তি ... কারণ দক্ষিণের কোনো দল কখনও ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেনি, দক্ষিণের কোনো দল কখনও উয়েফা কাপ জেতেনি, দক্ষিণের কোনো দল কখনও বিশ্ব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল না।’
নেপোলিতেও ম্যারাডোনা অন্যায্য বেতন ও নীতিমালার কারণে ক্লাব মালিকদের মুখোমুখি হতে দ্বিধা করেননি। ১৯৮৪ সালে তিনি ক্লাব কর্মকর্তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে দরিদ্র শিশুদের চিকিত্সার জন্য অর্থ সরবরাহের উদ্দেশ্যে নেপলসের সবচেয়ে দরিদ্রতম শহরতলির একটি কর্দমাক্ত জমিতে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেছিলেন। বরাবরই স্থানীয় দরিদ্র জনগণের সঙ্গে সংহতি দেখিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।
নেপলসের বাসিন্দারা ম্যারাডোনাকে এতোটাই ভালোবাসতেন যে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইতালি বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচে অনেকে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করেন। কাকতালীয়ভাবে ওই ম্যাচটি নেপলসেই হয়েছিল।
মৃত্যুর পর, তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ইতালির নেপলস শহরের স্থানীয় স্টেডিয়াম সান পাওলোর নাম বদলে দিয়াগো ম্যারাডোনার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ফুটবলের ইতিহাসে ১৯৮৬ সাল অত্যন্ত আলোচিত একটি বছর। ১৯৮৬ সালের ফুটবল মহাযজ্ঞে আর্জেন্টাইন অধিনায়কের জাদুকরী পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়েছিল গোটা বিশ্ব। ১৯৮৬ সালে ‘হ্যান্ড অব গড’ ও ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নিয়ে আলোচনা হলেও এর আড়ালে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তা অনেকটাই অনুচ্চারিত। ইংলিশ ভক্তরা এই গোল দুটির জন্য ম্যারাডোনাকে কখনও ক্ষমা করেনি। ইংলিশ ভক্তরা এখনও প্রথম গোলের ছলনা ও দ্বিতীয় গোলটির অতীন্দ্রিয় দক্ষতার জন্য অপমানিত বোধ করেন।
তব, মার্গারেট থ্যাচার ক্ষমতায় থাকাকালীন নব্য-সাম্রাজ্যবাদের শীর্ষে থাকা ইংল্যান্ডের দুঃখ বাড়িয়ে এই গোল দুটিকে ব্যাপকভাবে উদযাপন করে আর্জেন্টিনা।
আলজাজিরা জানায়, অক্টোবরে ম্যারাডোনার ৬০তম জন্মদিনে তার স্বপ্নের উপহার কী জানতে চাইলে ম্যারাডোনা কৌতুকছলে বলেছিলেন, ‘ইংলিশদের বিপক্ষে আর একটি গোল দেওয়া। এবার ডান হাত দিয়ে!’
নিজের দেশ আর্জেন্টিনাকেও ম্যারাডোনা অনেক বেশি ভালোবাসতেন। শ্রেণি, জাতি ভেদে সমস্ত আর্জেন্টাইনরাই তাকে পছন্দ করতেন। যখনই ম্যারাডোনা ফুটবলের মাঠে বা বাইরে উপস্থিত হতেন, তাকে কেবল একজন খেলোয়াড় না তার চেয়েও অনেক বেশি হিসেবে দেখতেন সবাই, তাকে দেখে উচ্ছ্বাসিত হতেন।
ম্যারাডোনা তার বিদ্রোহের জন্য, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বর্তমানে কোনো খেলোয়াড়ের মধ্যে এটি দেখা যায় না। বিজ্ঞানী, লেখক ও শিল্পীদের মধ্যে তো নয়ই।
ম্যারাডোনার মতো আরেকজন ছিলেন বক্সার মুহাম্মদ আলী। তিনিও সবসময় দুর্বলদের পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছেন। বিশ্ব মঞ্চে যারা উপেক্ষিত তাদের হয়ে কথা বলতে চেয়েছেন।
ম্যারাডোনা কিংবদন্তি হয়ে ওঠেছিলেন কেবল মাঠে তার পারফর্ম্যান্সের কারণে নয়, ভক্তদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধনের কারণেও। তিনি সবসময় জোর দিয়ে বলেছেন যে, বিলাসবহুল জীবনযাপন কিংবা মালিক বা কোনো অভিজাত শ্রেণির জন্য নয় বরং সাধারণ জনগণের জন্যই তিনি খেলছেন।
অধ্যাপক স্যানটিয়াগো জাবালা বলেন, ‘এমনকি মাদকাসক্তি নিয়েও তিনি সবসময় সৎ, নিরহঙ্করী ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “আমি ভুল করেছি, এবং সেই ভুলের মাশুলও আমি দিয়েছি। তবে ফুটবলে কখনও দাগ পড়েনি”।’
নেপলস, আর্জেন্টিনার জনগণ এবং আরও কয়েক কোটি অনুরাগীর কাছে ম্যারাডোনা ছিলেন মুক্তির প্রতীক। ১৯৯৭ সালে পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে অবসর গ্রহণের পরে, এই বিদ্রোহীভাব আরও জাগ্রত হয়।
ম্যারাডোনা পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য একটি ইউনিয়নকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন এবং ফিফাকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগে প্রকাশ্যে নিন্দা করেছিলেন।
তিনি ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিলেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ দক্ষিণ আমেরিকার বামপন্থী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, হুগো শ্যাভেজ এবং ইভো মোরালেসকে তিনি সমর্থন করেছিলেন।
২০০৫ সালে, তিনি আমেরিকার চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলনের সময় একটি প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় তার টি-শার্টে জর্জ ডব্লিউ বুশ একজন ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে লেখা ছিল।
অধ্যাপক স্যানটিয়াগো জাবালা বলেন, ‘ম্যারাডোনার বিদ্রোহ এবং কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে তার যে লড়াই সেটি থেকে খেলাধুলাকে আলাদা রাখা যায় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে খেলাধুলার ক্ষেত্রকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে করপোরেট চাপ বাড়ছে। পেশাদার খেলোয়াড়দের রাজনৈতিক বক্তব্য, দরিদ্র ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংহতি জানাতেও নিরুৎসাহিত করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেমন ম্যারাডোনার স্মৃতি স্মরণ করি, তাকে সম্মান করি তেমনি আমাদের তার উত্তরাধিকারও ধরে রাখা উচিত। খেলাধুলার বাণিজ্যিকীকরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলার বিরুদ্ধে যে চাপ সেটিকে প্রতিহত করতে হবে।’
Comments