মহামারির বছরটা ওষুধ শিল্পের
দীর্ঘ মহামারির প্রভাবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিল্পের আয় ব্যাপক পরিমাণে কমেছে। হুমকির মুখে হাজারো প্রতিষ্ঠান। তবে, এর ঠিক বিপরীত চিত্র ওষুধ শিল্পে।
সম্পূর্ণ এবং অফিসিয়াল তথ্য এখনো প্রকাশ করা না হলেও এই খাতের শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০২০ সালে দেশের ওষুধের বাজারে দুর্দান্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
জুলাই থেকে নভেম্বর মাসে এই শিল্পে রপ্তানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এর মাধ্যমে আয় হয়েছে ৬৯ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বলেন, ‘রোগীরা চিকিৎসা নিতে আবারও হাসপাতালে যেতে শুরু করেছেন এবং চিকিৎসকরা রোগী দেখছেন বলে ওষুধ শিল্পে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’
মহামারি সত্ত্বেও ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং দেশ-বিদেশের বাজারে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ চালিয়ে যায়। রেজা বিশ্বাস করেন যে, ২০২০ সালে এই শিল্প ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
ইনসেপ্টার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির বলেন, ২০২০ সালে ওষুধ প্রস্তুতকারীরা তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলেন। কারণ, তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে কাজ করেন।
বছর শেষে এই শিল্প পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই শিল্পে করোনার প্রভাব পড়েছে। এরপর ওষুধ প্রস্তুতকারীরা পরিবর্তন ঘটিয়েছে।’
এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বিপণন ও বিক্রয় পরিচালক মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সীমাবদ্ধতার মাঝে শিল্পটি বেশ ভালো করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো জেনেরিক অ্যান্টি-করোনাভাইরাস ওষুধ তৈরি করেছে, যা বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করেছে। ওষুধ শিল্প মহামারির সময় তার সক্ষমতা দেখিয়েছে।
‘আমরা অনেক দেশের তুলনায় করোনা-সম্পর্কিত ওষুধ ভালোভাবে তৈরি করতে পেরেছি। আমাদের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীরা নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে এই মহামারি আরও ভালোভাবে মোকাবিলায় সহায়তা করেছেন।’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক এসএম শফিউজ্জামান বলেন, ‘অ্যান্টি-করোনাভাইরাস ড্রাগ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরির প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এ বছর দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।’
ফেভিপিরাভির ও রেমডেসিভিরের মতো অ্যান্টি-করোনাভাইরাস ওষুধ উৎপাদন এই শিল্পের জন্য একটি দুর্দান্ত অর্জন ছিল।
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যান্টি-করোনাভাইরাস ওষুধগুলোর জেনেরিক সংস্করণ তৈরির দক্ষতা দেখিয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষ এই ওষুধ উপযুক্ত দামে কেনার সুযোগ পেয়েছে।’
বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের গ্লোবাল বিজনেসের পরিচালক মনজুরুল আলম বলেন, রেমডেসিভির রপ্তানি করে এ বছর প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আয় হয়েছে।
বাংলাদেশি রেমডেসিভির মধ্য আমেরিকা, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকায় রপ্তানি করা হয়েছে।
আমেরিকান বায়োফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা গিলিয়েড সায়েন্সেসের এই ওষুধটির জেনেরিক সংস্করণ তৈরি করছে এসকেএফ, বিকন, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো ও স্কয়ার ফার্মা।
এ ছাড়াও, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও চিকিৎসার জন্য মানুষ প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনেছে।
একমি ল্যাবরেটরিজের বিপণনের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জিয়াউদ্দিন জানান, মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে এই শিল্পটি কাঁচামাল আমদানিতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।
বাংলাদেশ এই শিল্পের প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচামাল ভারত, চীন ও ইউরোপ থেকে আমদানি করে থাকে।
রেনেটার আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের ব্যবস্থাপক অনন্ত সাহা বলেন, ‘ওষুধ সব দেশের জন্যই প্রয়োজনীয় পণ্য। সুতরাং, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পরও রপ্তানি ও দেশীয় বিক্রি কমেনি।’
অন্যতম প্রধান নির্মাতা ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রেনেটা ২৭টি দেশে পণ্য সরবরাহ করে এবং আফ্রিকান দেশগুলোতে বিতরণের জন্য ইউনিসেফের কাছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিকর পণ্য বিক্রয় করে থাকে।
অনন্ত সাহা বলেন, ‘আমরা ব্যক্তিগতভাবে ক্লায়েন্টদের কাছে যেতে না পারলেও ক্রেতারা অনলাইনে যোগাযোগ করে নতুন অর্ডার দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো কয়েকটি অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত বাজারসহ ১৪৫টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, এসকেএফ কখনোই তার দায়িত্ব থেকে পিছপা হয়নি। ‘ম্যানেজমেন্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল, কোভিড-১৯ সময়টিকে একটি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং মানবতার সেবায় নিজেদের সর্বোচ্চটা দিতে হবে।’
‘আমরা আক্রান্ত হয়েছি। আমাদের শত শত সহকর্মী কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন এবং ভুগেছেন। তবে, আমরা নির্ভীক। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের সক্ষমতার সবটুকু দিয়ে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস পেয়েছি।’
Comments