এশিয়ার ‘পানির খনি’ তিব্বতের নদীতে চীনের বাঁধ!

এশিয়ায় ‘পানির খনি’ বলা হয়ে থাকে তিব্বত মালভূমিকে। সেখানকার নদীগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ পানি প্রবাহিত হয় চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান দিয়ে।
Yarlung Tsangpo
তিব্বতের ইয়ারলুং নদী। ছবি: সংগৃহীত

এশিয়ায় ‘পানির খনি’ বলা হয়ে থাকে তিব্বত মালভূমিকে। সেখানকার নদীগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ পানি প্রবাহিত হয় চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান দিয়ে।

এই ১১টি দেশের মিঠাপানি, খাদ্যশস্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদন নির্ভর করে তিব্বত থেকে প্রবাহিত নদীগুলোর ওপর। এসব দেশের ১০০ কোটির বেশি মানুষের জীবনযাত্রায় এ নদীগুলোর সরাসরি প্রভাব রয়েছে।

গত বুধবার এশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছে এশিয়ার মিঠাপানির নিরাপত্তায় তিব্বতের নদীগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তিব্বত মালভূমি শুধু এশিয়ার মিঠাপানির প্রধান উৎসই নয়, অনন্যসাধারণ এই মালভূমি মহাদেশটির বৃষ্টিপাতেও প্রধান ভূমিকা রাখে।

তিব্বতের ইয়ারলুং নদীতে চীন বিশালাকৃতির বাঁধ দিতে যাচ্ছে— গত মাসে এমন সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় এ নিয়ে বিভিন্ন দেশে গবেষক, নীতিনির্ধারক ও কৌশলপ্রণেতাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এটি শুধু ভারতের জন্যেই উদ্বেগের বিষয় নয়, এর ফলে তিব্বতের নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও পানির সংকটে পড়তে পারে।

বাঁধের দেশ চীন

বর্তমানে চীন হচ্ছে বাঁধ-বহুল একটি দেশ। এক সময় মোঙ্গলদের আক্রমণ ঠেকাতে দেশটি ‘মহাপ্রাচীর’ তৈরি করেছিল। এখন এই দেশ নতুন করে ‘মহাপ্রাচীর’ তৈরি করছে নিজের ‘পানি নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে। ফলে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর পানিসহ জীবনযাত্রার নিরাপত্তা পড়ছে হুমকির মুখে।

তিব্বতকে নিজের আয়ত্তে নেওয়ার পর চীনে সেই অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। সুবিস্তৃত মহাসড়ক তৈরি করে চীনের প্রতিটি প্রধান শহরের সঙ্গে তিব্বতকে যুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত কয়েক দশকে চীন তিব্বতে তৈরি করেছে একের পর এক বাঁধ।

পুরস্কারপ্রাপ্ত কানাডীয় সাংবাদিক মাইকেল বাকলে তার ‘মেল্টডাউন ইন তিব্বত’ বইয়ে তিব্বতের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চীনের হস্তক্ষেপকে ‘পরিবেশহত্যা’ হিসেবে অভিহীত করেছেন।

লিখেছেন, ‘তিব্বতের নদীগুলো ভাটি এলাকায় বিশ্বের বড় বড় বদ্বীপ সৃষ্টি করেছে। সেসব এলাকার প্রায় ১০০ কোটি মানুষ কৃষি, শিল্প, মাছ শিকার ও খাবার পানি সংগ্রহসহ বিভিন্নভাবে তিব্বতের পানির ওপর নির্ভরশীল।’

‘অনাদিকাল থেকে তিব্বতের নদীগুলো ভাটি অঞ্চলে ভিন্ন জীববৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে। এখন সেসব নদীর ওপর একের পর এক বাঁধ দেওয়ায় প্রতি বছর সেখানকার চিত্র বদলে যাচ্ছে’ বলেও তিনি বইটিতে উল্লেখ করেছেন।

ভারতের ধর্মশালা-ভিত্তিক গবেষণা কেন্দ্র টিবেট পলিসি ইনস্টিটিউটের ফেলো ডেচেন পালমো সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘গত ৭০ বছরে চীনে ৮৭ হাজারের বেশি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁধ থেকে ৩৫২ দশমিক ২৬ গিগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়— যা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রাজিলের মোট উৎপাদিত জলবিদ্যুতের চেয়ে অনেক বেশি।’

এসব বাঁধ নির্মাণের ফলে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চীন যে সব বাঁধ নির্মাণ করেছে সেগুলোর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার বাঁধের উচ্চতা ১৫ মিটারের বেশি। এর ফলে এশিয়ার অন্য দেশগুলো কী পরিমাণ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না।

এতো উঁচু বাঁধের কারণে ভাটি অঞ্চলে বনভূমি, জলাভূমি ও তৃণভূমি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জলজপ্রাণীর জীববৈচিত্র্যও নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাইকেল বাকলে।

সমাধান?

জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্টস ২০১৯’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা ২০০ কোটি বাড়তে পারে। অর্থাৎ বর্তমানের ৭৭০ কোটি থেকে বেড়ে তা ২০৫০ সালে দাঁড়াবে ৯৭০ কোটিতে। সেসময় বিশেষ করে এশিয়ায় চালের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে।

বিশ্বের বৃহৎ ধান উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে আটটি দেশ তিব্বতের পানির ওপর নির্ভরশীল। তিব্বতের নদীগুলোর প্রবাহ কমে গেলে পানি-নির্ভর ফসল ধান উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদেন আরও বলা হয়েছে, আগামীতে পানি নিয়ে যুদ্ধের কথা প্রায়ই শোনা যায়। গবেষকরা মনে করছেন, আগামী দিনে সুপেয় পানি ও জলপথেও ওপর নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সংঘাত শুরু হবে। তখন পানিকে ব্যবহার করা হবে অস্ত্র হিসেবে। শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে তার পানির উৎস নষ্ট করা হবে।

তিব্বতের পানি প্রবাহের ওপর চীনের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে এশিয়ার অন্যান্য দেশকে একত্রিত হয়ে আন্তঃদেশীয় পরিবেশ আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, তিব্বতের পানির নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করছে এর নদী অববাহিকায় থাকা দেশগুলোর পানির নিরাপত্তা। তাই তিব্বতের পানির নিরাপত্তা দেওয়া গেলে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago