‘পুরো সমাজই যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছে’

ধর্ষণ-নিপীড়ন বা এ ধরনের যেকোনো ঘটনায় সমাজ প্রথমেই আঙুল তুলে ভুক্তভোগী নারীর দিকে। ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবারের ওপর দায় চাপানোই প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব দোষ যেন তাদেরই! রাজধানীর কলাবাগানের ঘটনায়ও তেমনটিই পরিলক্ষিত হয়েছে, হচ্ছে।

কিন্তু, এ ধরনের ঘটনায় দায় কি আসলেই ভুক্তভোগী নারীর? সব ঘটনাতেই তাদেরকেই কেন দায়ী করা হয়? আসল দায় কার? এই যে সামাজিক-নৈতিক অবক্ষয়, এর থেকে উত্তরণে বর্তমানে করণীয় কী?, দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘নারীদের ওপর দায় চাপানোটাই আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে গেছে। এখানে প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের গোটা ব্যবস্থাটাই হচ্ছে পেট্রিয়ার্কল (পিতৃতান্ত্রিক)। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। পেট্রিয়ার্কল সিস্টেমে দোষ প্রথমে নারীদের ওপরেই পড়ে যে, তারা এরকম, তারা ফ্রি। এক্ষেত্রে যেমন বলা হচ্ছে, মেয়েটি নিজেই গেছে, ফেসবুকে প্রেম করেছে। এটা আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেই আছে। কিন্তু, এটা খুবই অন্যায় কাজ। নারীদের ওপর দোষ চাপানোটা খুবই অন্যায়। যারা এটা করে, যারা একটা মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নেয়, তারাই তো আসল অপরাধী। দোষ তো তার ওপরে পড়া উচিত। কিন্তু, আমাদের সিস্টেমে আছে দোষ নারীদের ওপর চাপানো। যেটা খুবই অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য।’
‘আমি নির্দিষ্ট করে বলতে চাই যে, এটা পুরুষতান্ত্রিক নয়, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে সব ক্ষমতা পুরুষের হাতে এবং পুরুষই যা ইচ্ছা করবে, সহিংসতাও সেই করবে এবং দোষ ভুক্তভোগীর ওপর চলে যাবে। এই যে নারীদের ওপর দোষ চাপানো, সেটা কিন্তু, কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা একটা প্যাটার্ন। সবগুলো ঘটনার ক্ষেত্রেই এই প্যাটার্নটা চলে, যা আমরা লক্ষ্য করেছি’, বলেন তিনি।
বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে যারা কিশোর-কিশোরী, তাদের জীবনে কোনো অ্যাডভেঞ্চার নেই। তাদের জীবনে কোনো চিত্তবিনোদন নেই। বিশেষ করে করোনার সময় তারা একেবারে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। সেজন্য পারভারশনগুলো চলে এসেছে। এক্ষেত্রে শাস্তি-বিচার এগুলো তো আছেই। তবে, এটা আমাদেরকে বলতে হবে যে, আমাদের ব্যবস্থার মধ্যে এগুলো আছে। কাজেই কিশোর-কিশোরীদের দিকে আমাদের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। যেটা দেওয়া হয় না। অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা কী করে, তারা কীভাবে দিন কাটায়, তারা ফেসবুকে কতটা সময় নষ্ট করে, তারা কী ধরনের বিনোদন নিচ্ছে, এগুলো দেখতে হবে। শুধু পরিবার নয়, জাতীয়ভাবে এ উদ্যোগ নিতে হবে।’
‘আগের দিনে পাড়া-মহল্লায় নানা ধরনের সংস্কৃতিক কার্যক্রম হতো। সেটা এখন নেই। ছেলে-মেয়েরা শুধু স্কুল-কলেজ আর কোচিংয়ে যাবে, তাদের জীবনে আর কোনো বিনোদন নেই, তা হলে তো হবে না। গোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি সংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন। যার মাধ্যমে তাদেরকে সামাজিকভাবে ঘরের বাইরে আনা যাবে, নানা ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে তাদেরকে যুক্ত করা যাবে। অন্যথায় পরিস্থিতি খুব ভয়ঙ্কর হবে। আর পরিশেষে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। ভুক্তভোগী নারীর ওপর দোষ চাপানোর মতো অমানবিক-অন্যায় অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে’, বলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবক্ষয় এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে যে, প্রত্যেকেই কাউকে না কাউকে দোষ দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করছে। মেয়ের পরিবার হোক আর ছেলের পরিবার হোক, সামগ্রিকভাবে সবারই একটা দায়িত্ব আছে ছেলে-মেয়েদেরকে শাসন করা। ছেলে-মেয়েরা যাতে খারাপ পথে না যায়, সেখানে বাবা-মায়ের অবশ্যই একটা ভূমিকা আছে। আমার কাছে মনে হয় সামগ্রিকভাবে সমাজটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যে কারণে এ ধরনের বীভৎস ঘটনা ঘটেছে। যা হয়েছে, একটা সুস্থ মানুষের পক্ষে সেটা ভাবাই কষ্টকর। মেয়েটা এভাবে মারা গেল, ছেলেটা এতটা নৃশংস হলো। কিন্তু, এ বিষয়ে নিউজ কাভার করা এবং মানুষের প্রতিক্রিয়া, এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও একটা অসুস্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। মানে, মানুষ এ ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, সেটির ভেতরেও আমি সুস্থতা দেখছি না।’
‘এ ঘটনায় ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক যে ভাষায় গণমাধ্যমে কথা বলেছেন, তাতে আমি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছি। মিডিয়াও জানতে চায়, তিনিও বলেছেন। এখানে মিডিয়ারও তো একটা ভূমিকা আছে। শুধু অন্যর ওপর দোষ চাপিয়ে দিলেই হবে না। ফরেনসিক চিকিৎসকের নিউজটা দেখে এতই মর্মাহত হয়েছি, এই চিকিৎসকের তো আক্কেল বলে কিছুই নেই। তিনি যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, সেভাবে বলার প্রয়োজন ছিল না। এ ছাড়া, বাংলাদেশে কি নারী চিকিৎসক নেই? একটি নারীর ময়নাতদন্তের জন্য একটি নারী চিকিৎসক তো থাকতে পারত? সব বিভাগেই তো নারী চিকিৎসক আছে। তাই দোষ চাপানোর ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই উচিত নিজের দিকে তাকানো যে, আমরা নিজেরা কতটা সংযত? সমাজের মানুষ কতটা সংযত? সার্বিকভাবে মনে হয়, আমাদের মধ্যে নৈতিকতার অভাব রয়েছে, কাণ্ডজ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করার অভ্যাস রয়েছে। কলাবাগানের এই ঘটনায় পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা অসুস্থতা দেখলাম। ছেলেটা যেমন অসুস্থ, তেমনি ঘটনাটি নিয়ে যেসব প্রতিবেদন-প্রতিক্রিয়া দেখলাম, সেখানেও বিকৃত রুচি পরিলক্ষিত হয়েছে।’
ভুক্তভোগীর প্রতি সবসময়ই সহানুভূতি নিয়ে কথা বলা উচিত বলে মনে করেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ‘সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, তাই বলে কি এ ধরনের ঘটনা ঘটবে? এ ধরনের ঘটনা ঘটার পরে ওই মেয়ের বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের অবস্থাটা কী? সেটা কেউ ভেবেছে? সেটাও তো ভাবতে হবে। এটা তো ছোটখাট কোনো নৃসংশতা নয়। তাই এ বিষয়ে বিতর্ক নয়, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতার পরিচয় না দেওয়াই ভালো। আর মিডিয়ার ক্ষেত্রেও সংবাদ প্রকাশে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।’
‘সবমিলিয়ে এ ঘটনার পরে যা ঘটেছে, তাতেও আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। মনে হয়েছে, পুরো সমাজই যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সমাজকে এসব ঘটনা এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর না ঘটে। যারা অপরাধটা করে, তারা যেমন অসুস্থ, সেই অপরাধ নিয়ে যারা বিকৃত মন্তব্য করে, তারাও মানসিকভাবে অসুস্থ’, যোগ করেন সৈয়দ আবুল মকসুদ।
ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের ওপর দায় চাপানোর কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘(কলাবাগানের) ঘটনাটা যাই হোক, কিন্তু, মৃত্যু তো সম্মতিতে হতে পারে না। যখন মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনা ঘটেছে, তখন নিশ্চই তার (ভুক্তভোগীর) ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু ছিল। সেটাকে কোনোভাবেই চোখের আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি দেশে এখন হাই টাইম চলে এসেছে যে, ভুক্তভোগীকে যে দোষারোপ করা হয়, এর বিরুদ্ধে আইন প্রমালগেট করা। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগী নারী বা তার পরিবারের ওপর যে দায় দেওয়া, সেটা একেবারেই দেওয়া যাবে না। যেমন কেউ সরকারের সমালোচনা করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে ফেলে। যারা ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনায় ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করে, সেগুলো বাড়াবাড়ি। এসব ক্ষেত্রে যেখানে ন্যায়বিচার জড়িত, সেখানে কোনোভাবেই যাতে ভুক্তভোগীকে দোষারোপ না করা হয়, এজন্য আইনি ব্যবস্থা প্রয়োজন।’
যেকোনো ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীকেই দায়ী করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সামাজিক অবস্থা হলো, মেয়েটা গেল কেন? মেয়েটা পোশাকটা অন্যভাবে পরে ছেলেদেরকে প্রোভোক করেছে। কিন্তু, ছেলেরাও তো সুন্দর পোশাক পরে। পরে না? তখন কি মেয়েরা প্রোভোকড হয়ে ছেলেদের সঙ্গে এসব করে? মেয়েদেরকে “পণ্য” হিসেবে দেখানোটা সমাজের অনেকদিনের ট্রেন্ড। সেটাকে আমাদের একদমই ভেঙে দিতে হবে। সেটা যে ভাঙছে না, তা ঠিক নয়। অনেক জায়গায় ভাঙছে। কিন্তু, প্রচুর মূল্য দিতে হচ্ছে। তাই আমি বলতে চাই যে, এখানে ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, একটা মেয়ের পরিণতি হয়েছে মৃত্যু। যদি পারস্পরিক সম্মতিতেও শারীরিক সম্পর্ক হয়, তাহলে সেটার পরিণতিতে মৃত্যু হবে? এটা বলা সম্ভব? কীভাবে এটা জাস্টিফাই করা যায়? কাজেই কোনো জায়গাতেই ভুক্তভোগীকে দোষারোপের সুযোগ নেই। কোনো জায়গাতেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। এমনকি কেউ বিবাহিত হলেও সেটা করতে পারবে না।’
‘আমার কাছে এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি মনে হয় যে, ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার বিরুদ্ধে একটা আইন করতে হবে। তা ছাড়া আর হবে না’, বলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
Comments