আয়েশা খানম এক সংগ্রামের নাম
চলে গেলেন আয়েশা খানম আপা। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের প্রথমসারির নেতা, অন্যতম অগ্রদূত, পুরোধা, নারীনেত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি, এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী, আমাদের পথ প্রদর্শক আয়েশা আপা চলে গেলেন নক্ষত্রের দেশে, না ফেরার দেশে।
মানুষ এ পৃথিবীতে আসে ক্ষণিকের জন্যে। কিন্তু, একেকজন আসেন যারা দু’হাত ভরে শুধু দিয়েই যান। তেমনি ছিলেন তিনি।
অনেকদিন দেখা নেই আপার সঙ্গে। শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৯ সালে জুনে ইউএনডিপির এক সেমিনারে। আলোচনার এক পর্যায়ে আমি নারী আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। আপা আমার সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেছিলেন।
আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের নারী আন্দোলন কি কিছুটা থমকে গেছে? কেনো আর আগের মতো আমরা অনেক কিছুতে একমত হয়ে এক সঙ্গে কাজ করতে পারি না? কেনো এত বিভাজন আমাদের মধ্যে— যা অনেক সময় আমাদের আন্দোলনকে কিছুটা পিছিয়ে দেয়?
সমস্যাটা কোথায়— তা তিনি আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝালেন। বললেন, নারী আন্দোলনের মধ্যেও ভিন্নতা থাকতে পারে। সবাই যে সব বিষয়ে ঐক্যমতে আসবে তা নাও হতে পারে। মূল বিষয়ে এক সঙ্গে কাজ করাটাই জরুরি। নারী আন্দোলনের গতিধারা নিয়েও তিনি অনেক কথা বলেছিলেন।
তারপর আপার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। অনেকবারই দেখা করতে চেয়েছি। আপার শারীরিক ক্ষতি হতে পারে এ ভাবনা থেকে বিরত থেকেছি। বেশ কিছুদিন নানান ব্যস্ততায় মহিলা পরিষদেও যাওয়া হয়ে উঠেনি।
যদিও আয়েশা আপার সঙ্গে আমার কখনো সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়নি, তবুও নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে, আন্দোলনে, সেমিনারে সব সময়ই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। এক সঙ্গে অনেক আন্দোলনে কাজ কয়েছি। বিভিন্ন পরামর্শে আপাকে পাশে পেয়েছি।
আয়েশা আপাকে আমরা একটু ভয়ই পেতাম। তা এ কারণে যে তিনি নিজে যেমন সাহসী ছিলেন, তেমনি চেয়েছিলেন আমারও তেমনি সাহসী হই। তেমনি স্পষ্ট করে কথা বলি। আপা যা বলতেন তা খুব স্পষ্ট করেই বলতেন। আমরা যারা ওনার চাইতে একটু তরুণ ছিলাম মাঝেমধ্যে আপা আমাদের শাসনও করতেন। ভুল হলে সোজাসাপটা বলতেন, ভুল ধরিয়ে দিতেন। খুব সাধারণ আর পরিপাটি জীবন ছিল আপার। কোনো বাহুল্যে আপাকে দেখিনি।
ছাত্রজীবন থেকে আমৃত্যু তিনি বঞ্চিত, নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, সার্বজনীন পারিবারিক আইন ও অন্যান্য আইন সংস্কার আন্দোলন, সিডও বাস্তবায়নসহ নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। অসম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী আয়েশা আপাকে কখনো আমি মাথা নত করতে দেখেনি।
১৯৮০ দশকের শেষ থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে নারীর বিষয়ে কাজ করতে গিয়েই আয়েশা আপার মতো গুণী, লড়াকু মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পারি। জেন্ডারবিষয়ে কাজ করার সুবাদে আয়েশা আপা, হেনা দাস, বেলা নবী, মালেকা বানু, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, রোকেয়া কবির, আরমা দত্ত, হামিদা হোসেন, শামিম আখতারসহ আরও অনেকেরই খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। আমি তখন বয়সে ওনাদের চেয়ে খানিকটা তরুণ। তাই শেখার আগ্রহ আমাকে খুব তাড়িয়ে বেড়াত।
মহিলা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল প্রায় ৬০ এর বেশি সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
দীর্ঘ একটা সময় আমি এই সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে খুব সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি কী সাহসী, কী যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন তিনি। কী কঠিন সিদ্ধান্ত এক লহমায় নিয়ে নিতেন আয়েশা আপা। মাঝে মাঝে মনে হতো আমরা পারব তো এসব বিষয়ে কাজ করতে? কিন্তু, চূড়ান্তভাবে বেশির ভাগ সময় তা ইতিবাচকই ভূমিকাই রেখেছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িকে তিনি প্রশ্ন করেছেন আজীবন।
রাজনীতিতে আয়েশা আপার ভূমিকা তো সবার জানা। তিনি হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন যুক্ত হয়েছিলেন। তারপর থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক আয়েশা আপার।
১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংগ্রামী নেত্রী আয়েশা খানম বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের একজন নিবেদিত প্রাণকর্মী। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ— সবগুলোতেই তিনি সামনের সারিতে ছিলেন। তাই ভয় বলে কিছু আপার ছিল বলে মনে হয়নি। রাজনীতিতে এত বলিষ্ঠ ছিলেন বলেই এমন যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন যেন মনে হতো কেউ রেকর্ডে কথা বলছেন।
বৈশ্বিক নারী আন্দোলনেও ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আপার সঙ্গে আরও গভীরতা তৈরি হয়েছিল ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে। বেইজিং ইউনিভার্সিটির হোস্টেলগুলোতে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখান থেকে মূল ভেনু ছিল বেশ খানিকটা দূরে। আমরা একই হোস্টেলে ছিলাম। আমরা শাটল বাসে করে যেতাম। যাওয়া-আসার পথে কত গল্প যে হতো। মনে পড়ে, অনুষ্ঠানের প্রথম দিন শাড়ি পড়লেও পরের দিনগুলোতে শাড়ি পরিনি বলে আপার বকাও খেয়েছি। কিন্তু, সেটি ছিল স্নেহের, আদরের। এটাই ছিল তার ভালোবাসার কৌশল।
সারা জীবন বহু দেশ ঘুরলেও আপা শাড়িই পরতেন সবসময়। বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রতি ছিল তার অকৃতিম ভালোবাসা। নিউইয়র্কের রাস্তায় বরফে শাড়ি পরেই জাতিসংঘের সভায় যোগ দিতেন তিনি। কখনো এটিকে ‘ঝামেলা’ হিসেবে দেখতেন না।
২০১৩ সালে যখন হেফাজত ইসলামের বিরুদ্ধে আমরা একটি বড় প্রতিবাদ সভা করি, তখন প্রায় প্রতি বিকেলেই চলে যেতাম সেগুনবাগিচা মহিলা পরিষদে। আর কি করে তা সফল করা যায় তা নিয়ে সবাই মত্ত থাকতাম। তিনি শুধু যে সম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন তা নয়, এর বিরুদ্ধে কথা বলতে তিনি কখন পিছপা হয়নি। সে সময় হেফাজতের ১৩ দফার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে ছিল নারী সমাজ।
আয়েশা আপার নেতৃত্বে হেফাজতের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলতে সক্ষম হয়েছিল নারী সমাজ। এরপর নুরজাহান, ইয়াসমিন, তৃষা, সীমা, রূপাসহ এরকম হাজারো নারীর ওপর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি।
আয়েশা আপা কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না, আর নমনীয়ও হতেন না অন্যায়ের কাছে। ইউএনডিপির পুলিশ সংস্কার কর্মসূচিতে কাজ করার সময় আপার সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছে। পুলিশকে জেন্ডার সংবেদনশীল করার ব্যাপারে কিংবা তাদের সঙ্গে কাজ করাকে যখন অনেকেই ইতিবাচক বলে মনে করতেন না সেখানে আয়শা আপা এই কাজটাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।
পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বদলানোর জন্যে এ কাজটা যে জরুরি তা তিনি বিশ্বাস করতেন। পুলিশের সঙ্গে কাজ করার সুযোগটা খুব দরকার ছিল বলে মনে করতেন তিনি। বাংলাদেশ পুলিশ ওইমেনস নেটওয়ার্ক ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠায় খুবই খুশি হয়েছিলেন তিনি।
ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে জীবনাবসানের পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নারীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লড়াই করে গেছেন। তার জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল নারীর মর্যাদা, মুক্তি ও সমতা প্রতিষ্ঠা।
তার মৃত্যুতে নারী আন্দোলন এক লড়াকু যোদ্ধাকে হারালো। হারালো এক নিবেদিত প্রাণ কর্মীকে। এক নির্ভীক নারী নেত্রীকে। তার অবদান বাংলাদেশের নারী সমাজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে চিরদিন স্মরণ করবে। আয়েশা আপা আমাদের প্রতিটি কাজে পাশেই থাকবে। লড়াইয়ের ময়দানে ঠিকই দেখা হবে। মিছিলে আপনিও পাশেই থাকবেন। আমাদের ওপর রাগ করবেন, আবার আদরও করবেন। আনমনে হয়তো জড়িয়েও ধরবেন। ভালো থাকুন আয়েশা আপা পরপারে।
ফাওজিয়া খোন্দকার ইভা: নারী আন্দোলন কর্মী ও নির্বাহী পরিচালক (Honorary), প্রাগ্রসর
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments