টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিতের আহ্বান টিআইবির
কোভিড-১৯ মহামারি থেকে সুরক্ষা পেতে টিকা সংগ্রহের ক্রয় পদ্ধতি, প্রাপ্তি এবং অগ্রাধিকার অনুযায়ী বিতরণ প্রক্রিয়ায় যেকোনো ধরনের বিতর্ক ও বিভ্রান্তি দূর করতে সকল পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় জরুরি কেনাকাটার নামে স্বাস্থ্যখাতে অবারিত দুর্নীতির ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে বৃহৎ এই টিকা কার্যক্রমে যেকোনো মূল্যে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রযোজ্য আইন ও বিধি অনুসরণের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।
আজ মঙ্গলবার টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারি থেকে সুরক্ষা পেতে কার্যকর টিকার সংখ্যা এখন পর্যন্ত খুবই কম হওয়ায় এবং এর উৎপাদন ও সরবরাহ সীমাবদ্ধতা থাকায়, এর প্রাপ্তি নিয়ে শুরু থেকেই বিশ্বজুড়ে একধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষণীয় ছিল। এমন বাস্তবতার মাঝেও সরকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা ভারতের সেরাম ইন্সস্টিটিউটের কাছ থেকে দ্রুত সংগ্রহের উদ্যোগ সাধুবাদ পাবার যোগ্য হলেও সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক চুক্তি এবং এই উৎস থেকে টিকার সময়মতো প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিতর্ক এড়াতে পারেনি বরং বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘টিকার প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যেভাবে বাণিজ্যিক চুক্তিটিকে দুই দেশের জি-টু-জি বলার চেষ্টা চালিয়েছে, তা অনভিপ্রেত। অন্যদিকে ভারতে টিকার অনুমোদনের পরদিনই যেভাবে দ্রুতগতিতে কোভিশিল্ডের অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের বিদ্যমান আইন কতোটা মানা হয়েছে এবং কোন কোন নথির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। একইভাবে সরাসরি কেনা টিকার জন্য বেক্সিমকোকে তাদের খরচ ও কমিশন বাবদ যে মূল্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তা কোন নীতি বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নেওয়া হয়েছে বা এর পেছনের যুক্তি বা বিবেচনা কী ছিল, তাও পরিষ্কার করতে পারেনি। এটি যেকোনো পর্যায়ের সরকারি কেনাকাটার স্বচ্ছতার পরিপন্থী। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার মনে রাখা জরুরি যে, মহামারি যেন কোনোভাবেই কারও জন্য অন্যায় সুবিধার মাধ্যমে পকেটপূর্তির উৎসবে পরিণত না হয়।’
কোভিড-১৯ এর টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দেশে চীনা টিকা সিনোভ্যাকের ট্রায়াল চালানোর সিদ্ধান্ত হলেও বেশ কয়েকমাস ঝুলে থাকার পর সেটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আবার দেশীয় কোম্পানি গ্লোব বায়োটেকের টিকার ট্রায়াল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন মিলেছে টিকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তার বিতর্কের মাঝেই। একইভাবে চীনা কোম্পানি আনহুই জিফেই এর টিকার ট্রায়াল চালানোর চিন্তাভাবনার কথা জানা যাচ্ছে সমালোচনার মুখে। এর মাঝে সংরক্ষণ জটিলতা থাকার পরও কোভ্যাক্স উদ্যোগের অংশ হিসেবে ফাইজারের টিকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখানে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি মূল্যায়ন অনুযায়ী ফাইজারের টিকা সংরক্ষণ ও ব্যবহারে যেখানে ৬৪ জেলার ৫৬টিতেই মানসম্পন্ন বিশেষ শীতলীকরণ ব্যবস্থা নতুন করে তৈরি করতে হবে এবং টিকাটির প্রয়োগে বিশেষ সিরিঞ্জের প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এমন সিদ্ধান্ত কতোটা ফলদায়ক হবে এবং টিকার তুলনামূলক দরের বিষয়টি কতোটা বিবেচনা করা হয়েছে, তা পরিষ্কার করা প্রয়োজন।’
পর্যাপ্ত টিকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে সরকার বিনামূল্যে জনসংখ্যার আশি ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করলেও এটির প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আরেক দফা বিভ্রান্তি তৈরির শঙ্কা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলন, ‘করোনোর টিকা প্রথম ডোজ প্রয়োগের একমাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কথা প্রাথমিকভাবে জানা গেলেও এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ করা হবে চার সপ্তাহ নয়, আট সপ্তাহের ব্যবধানে। এক্ষেত্রে, বড় বিষয় হচ্ছে এ সিদ্ধান্ত কেন কীভাবে পরিবর্তন করা হলো, এর পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী বা বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ নেওয়া হয়েছে কী-না তা পরিষ্কার করা হয়নি। একইভাবে টিকা প্রাপ্তির অগ্রাধিকার নির্ণয় প্রক্রিয়া কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, সে সম্পর্কেও জনমনে পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয়নি। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ ধরনের বড় আকারের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে কতোটা স্বচ্ছতার সঙ্গে ও বিভ্রান্তি দূরীভূত করে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করা যায় তার ওপর। কেননা এই টিকাদান কর্মসূচি সফল না হলে একদিকে যেমন মহামারির হাত থেকে দ্রুত স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফেরা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে, তেমনি বিনামূল্যে টিকাদান কর্মসূচি চালাতে নেওয়া চার হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয়ের উদ্দেশ্যই ভেস্তে যাবে।’
Comments