তিনি সহিংসতা করলেন, শাসক দলের বিরোধিতা করে নির্বাচনেও জিতলেন
নির্বাচনের আগে ব্যাপক সহিংসতা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। মামলায় অভিযুক্ত হয়ে নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাতে সক্ষম হয়েছেন। আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভার মেয়র পদে জয়ের মুখ দেখলেন মো. মুক্তার আলী।
আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা হলেও মুক্তার আলী সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, রাজশাহী-৬ (চারঘাট এবং বাঘা) আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম আড়ানী পৌরসভার নির্বাচনে তাকে সমর্থন করেছেন। তিনি আরও বলেন, এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তিনি পাননি কারণ সেটা টাকার বিনিময়ে অন্যত্র বিক্রি হয়েছিল।
একইসঙ্গে পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. শহীদুজ্জামানও প্রকারান্তরে জানিয়েছেন, প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম এবং দলের অধিকাংশ স্থানীয় নেতাদের তিনি কার্যত পাশে পাননি।
তবে শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচনি আচরণবিধিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কোনো কাজ করতে পারেননি। সেই সঙ্গে, মুক্তার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সমর্থন পাওয়ার যে দাবি করেছেন, তা স্পষ্ট ভাষায় উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
শাহরিয়ার আলম আড়ানীতে যান নির্বাচনের একদিন আগে। ভোট দিতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা একজন রাজনৈতিক কর্মীর জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক যে নির্বাচনি বিধিনিষেধের কারণে মন্ত্রী হয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয় না।’ সে সময় তিনি নৌকা প্রতীকের জয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
গতকাল অনুষ্ঠিত রাজশাহীর তিনটি পৌরসভা নির্বাচনে দুটিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এবং একটিতে বিদ্রোহী প্রার্থী বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। সেই একটি পৌরসভা বাঘা উপজেলার আড়ানী। সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মুক্তার আলী পাঁচ হাজার ৯০৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শহীদুজ্জামান পেয়েছেন চার হাজার ৩০০ ভোট। আর বিএনপির প্রার্থী মো. তোজাম্মেল হক পেয়েছেন এক হাজার ৩১২ ভোট। মোট নয়টি ভোটকেন্দ্রের ছয়টিতেই জয় পেয়েছেন মুক্তার আলী। এমনকি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন সেই কেন্দ্রেও তিনি জয় লাভ করেছেন। সেখানে তিনি পেয়েছেন এক হাজার ১৯৫ ভোট। জয়গুন নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের শহীদুজ্জামান মাত্র ৭৭টি ভোট পেয়েছেন। সবগুলো কেন্দ্রের মধ্যে এখানেই সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, মুক্তার আলী এসএসসি পাস এবং ২০১০ সালের একটি হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলায় অভিযুক্ত।
স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলমের পছন্দেই ২০১৫ সালের নির্বাচনে মুক্তার আলী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের আড়ানী পৌর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন।
এবারের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার জন্য দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর থেকেই মুক্তার আলী দলের মনোনীত প্রার্থী মো. শহীদুজ্জামানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন।
গত ১৩ জানুয়ারি রাতে শহীদুজ্জামানের সমর্থকদের উস্কানির পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তারের সমর্থকরা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শহীদুজ্জামানের পথসভায় হামলা করে। অভিযোগ উঠেছে যে, তারা শহীদুজ্জামানের নির্বাচনি কার্যালয় ভাঙচুর করে, আগুন ধরিয়ে দেয়, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়, আড়ানী বাজার তছনছ করে দেয়। স্থানীয় বাসিন্দারা গুলি চলেছে বলেও অভিযোগ করেছেন। একই রকম অভিযোগ শহীদুজ্জামানের সমর্থকদের বিরুদ্ধেও রয়েছে।
পরদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় এক হামলায় শহীদুজ্জামানের দুই সমর্থক মারাত্মক আহত হন। তারা অভিযোগ করেন, মুক্তারের সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে।
পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে ভোটের আগেরদিন পর্যন্ত পুরো আড়ানী জুড়ে থমথমে ও ভূতুরে পরিবেশ বিরাজ করে। সেখানে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য হয়নি, রাস্তায় চলাচল কম ছিল।
এসব ঘটনায় বাঘা থানায় দুটি মামলা দায়ের হয়। তাতে মুক্তার আলীসহ অন্তত ৪৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দুই মামলায় মাত্র দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা থাকার পরেও মুক্তার আলী নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাতে পেরেছেন।
মুক্তার আলী বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মামলা করলেই আমাকে কেন পুলিশ গ্রেপ্তার করবে? তারা অভিযোগের সত্যতা যাচাই করবে না? সে (সহিংসতার) সময় তো আমি বাসায় ছিলাম।’ সহিংসতার সময় বাসায় থাকার কথা বললেও তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে তার পায়ে একটি ক্ষতস্থান দেখিয়ে বলেন যে, সহিংসতার সময় তিনি ককটেলের স্প্রিন্টারে আহত হয়েছেন।
মো. মুক্তার আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি নৌকাকে (প্রতীককে) স্যালুট করি। কিন্তু নৌকার প্রার্থীকে সাধারণ জনগণ পছন্দ করেনি। আমি নৌকা প্রতীক নিয়েই গত নির্বাচনে মেয়র হয়েছি। এবারের নির্বাচনে যে কোনো কারণে মনোনয়ন টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যায়। বিক্রি হওয়ায় আমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট করতে হয়েছে। আমি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত বর্তমান মেয়র, বাঘা-চারঘাটের এমপি মহোদয় আমাকে কখনো ত্যাগ করতে পারে না। এ জন্য পারে না যে, আমার (মনোনয়ন পাওয়ার) অধিকার আছে। সংসদ সদস্য যখন (আমাকে) বলেছেন যে টিকিটটা (মনোনয়ন) ও (শহীদুজ্জামান) অন্যভাবে নিয়েছে, তখন আমার দাবি তো থাকবেই যে আমার জনগণ কী চাচ্ছে (সেটা দেখা)।’
তিনি বলেন, ‘যখন আমাকে টিকিট দেওয়া হরো না, তখন পরের দিনই সাড়ে চার হাজার মানুষ মানববন্ধন করল আমার মনোনয়নের দাবিতে। তার পরের দিন তিন হাজার মানুষ গণস্বাক্ষর করে বললো তারা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীকে বয়কট করল এবং তার টিকিট বাদ দিয়ে আমাকে টিকিট দিতে বললো। জনগণের দাবিতেই আমি বিদ্রোহী হয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছি।’
আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহীদুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টার’র সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমার মনের অবস্থা ভালো নেই। আমি কাউকেই আমার পরাজয়ের জন্য দায়ী করি না। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে তাদের (শাহরিয়ার আলম ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের) সহযোগিতা যদি আমি না-ই পাব, তবে আওয়ামী লীগ এবং এর সভানেত্রী কেন আমাকে মনোনয়ন দিলেন। নৌকা প্রতীক হেরে যাওয়া মানে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়া, (প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী) শেখ হাসিনার হেরে যাওয়া। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিজে যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, সেখানে নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোট পরেছে মাত্র ৭৭টি। এই ফলাফল জানার পর আমি আর চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করিনি, আমি বাসায় ফিরে এসেছিলাম। কারণ নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আমি হেরে যাচ্ছি। মন্ত্রীর শত শত কর্মীরা তার কথার বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন, এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? এত কম ভোট পাওয়ার মতো অযোগ্য প্রার্থী আমি ছিলাম না। আমি শিক্ষিত, আমি সন্ত্রাস চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত না, মাদকাসক্ত নই। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারপরও আমাকে এমন শাস্তি দেওয়া হলো কেন আমি বুঝতে পারছি না।’
প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ডেইলি স্টারকে বলেছেন, মুক্তারের সমর্থন পাওয়ার দাবি তার নিজের ‘রাজনৈতিক স্টান্ট’ ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘তিনি (মুক্তার) ভোটারদের পক্ষে নিতে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধুর স্লোগান, আমার নাম এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করেছেন।’
‘মেয়র হিসেবে আগের মেয়াদে কার্যকলাপ অসন্তোষজনক হওয়ায় মুক্তার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। আমাদের দলের তাকে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, নিঃসন্দেহে,’ তিনি বলছিলেন।
মুক্তারের বিজয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, একটি স্থানীয় বিষয় সেখানে নির্ধারক হিসেবে কাজ করেছে।
‘আড়ানী পৌরসভার ভোটাররা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়েছিল: একটি রেললাইনের এক পাশের, অন্য গ্রুপটি রেলপথের অপর দিকে থাকে। মুক্তারের দিকের ভোটাররা শহীদুজ্জামানের ভোটারদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি ছিল।’
তবে এই পৌরসভার নির্বাচনের তাৎপর্য হলো এটি ছিল ‘সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত’ একটি নির্বাচন, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং বিদ্রোহী প্রার্থী মিলে ৮৮ শতাংশের বেশি এবং বিএনপির প্রার্থী ১১ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট পেয়েছেন।
Comments