একটি পরিবারের বেঁচে থাকার গল্প

পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে ১০ বছরের পিয়া আক্তার লামিয়া। তার ছোট বোন সাত বছরের লাবনী আক্তার পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। করোনা মহামারির ধকল থেকে পরিবারকে বাঁচাতে গত ছয় মাস ধরে মিরপুর-১১ বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে মাস্ক বিক্রি ও পথচারীদের ওজন মাপে এই দুই বোন।
মাস্ক বিক্রি ও পথচারীদের ওজন মেপে পরিবারে বাড়তি অর্থের যোগান দেওয়ার চেষ্টা করে এই দুই বোন। ছবি: শাহীন মোল্লা

পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে ১০ বছরের পিয়া আক্তার লামিয়া। তার ছোট বোন সাত বছরের লাবনী আক্তার পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। করোনা মহামারির ধকল থেকে পরিবারকে বাঁচাতে গত ছয় মাস ধরে মিরপুর-১১ বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে মাস্ক বিক্রি ও পথচারীদের ওজন মাপে এই দুই বোন।

লামিয়া জানায়, তারা দুই বোন প্রতিদিন বিকেল ৪টার দিকে বাসা থেকে হেঁটে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে আসে। এখানে থাকে রাত ৮টা পর্যন্ত। তারপর ফিরে যায় বাসায়। কোনো দিন আয় কম হলে বাসায় একটু দেরিতেই ফেরে ওরা।

লামিয়ার মা বলেন, ‘রাত ৯টার মধ্যে দুই মেয়ে বাসায় না ফিরলে মন অস্থির হয়ে উঠে। ওরা যেখানে বসে মাস্ক বিক্রি করে সেখানে ছুটে যাই। ওখানে ওদের না পেলে আশেপাশের দোকানদারদের জিজ্ঞেস করি মেয়েরা কখন সেখান থেকে গেছে। যদি বলে, কিছুক্ষণ আগে গেছে তাহলে যে রাস্তা দিয়ে ওরা বাসায় ফেরে সে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে যাই। অনেক সময় রাস্তায় দেখা হয়, অনেক সময় দেখি বাসায় পৌঁছে গেছে।’

‘অনেক সময় বাসায় গিয়ে শুনি ওরা বাসায় ফেরেনি। তখন চিন্তা আরও বেড়ে যায়। অস্থির হয়ে যাই। আবার ওদের খুঁজতে বের হই কয়েকজন প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে,’ যোগ করেন তিনি।

প্রতিমাসেই অন্তত দু-তিন দিন এভাবে ওদের খুঁজতে বের হতে হয় বলে জানান লামিয়ার মা।

এত দুশ্চিন্তার মধ্যে থেকে ছোট মেয়েদের কাজে পাঠানোর কোনো ইচ্ছে না থাকলেও সার্বিক পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে তারা বাধ্য হয়েছেন বলেই জানালেন লামিয়ার মা।

মিরপুর-১১ নম্বরের এভিনিউ-৫ এর নর্দমার পাশে একটি টিনশেড ঘরে মাসে তিন হাজার টাকা ভাড়া বাসায় তিন মেয়েকে নিয়ে থাকেন লামিয়ার বাবা-মা।

লামিয়ার মা জানান, তিনি একটি ছোট গার্মেন্টসে চাকরি করেন। সকাল সাড়ে ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে যান কাজের উদ্দেশ্যে। বাসায় ফিরতে কোনো দিন সন্ধ্যা ৬টা, আবার কোনো দিন রাত ৮টা বাজে। দুই মেয়ের মতো তার স্বামীও পথচারীদের ওজন মাপেন এবং মাস্ক বিক্রি করেন মিরপুর-১০ এ।

স্বামী-স্ত্রীর আয় দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়াসহ কোনো রকমে পরিবারটির খরচ চলে যাচ্ছিল। কিন্তু গত বছরের মার্চ মাসে করোনা মহামারি সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়।

লামিয়ার মা যে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন সেটি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় লামিয়ার মায়ের আয় আর পুরোপুরি বেকার হয়ে পরেন লামিয়ার বাবা।

এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরে লামিয়া। পেট ফুলে যায় তার। চিকিৎসকরা জানান লামিয়ার লিভার ইনফেকশন। সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া পরিবারটি ঢাকায় মেয়ের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে না পেরে চলে যায় গোপালগঞ্জ, লামিয়ার নানার বাড়িতে চিকিৎসা করতে। তিন মাস গোপালগঞ্জ থেকে হাতের টাকা শেষ হয়ে গেলে ঢাকায় ফিরতে বাধ্য হন তারা। লামিয়ার চিকিৎসায় খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা।

ঢাকায় এসে তারা তিন মাসের বকেয়া বাসা ভাড়া নিয়ে চাপে পরে যান। গার্মেন্টসেও এই তিন মাস বন্ধ থাকাকালীন কোনো বেতন দেয়নি।

লামিয়ার মা আরও জানান, গত সাত বছর আগে লামিয়ার বাবা অবৈধপথে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় কনস্ট্রাকশন কাজ করতে গিয়ে একটি তিনতলা ভবন থেকে পড়ে যান তিনি। ডান হাত, ডান পায়ের কয়েকটি হাড় ভেঙে গেলে তাকে বাংলাদেশের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ তিনি ফেরেন শূন্য হাতে। উল্টো বাংলাদেশে আসার পর তার চিকিৎসার জন্য ৭০ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়। সেই টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি।

স্বামী-স্ত্রী যা আয় করছিলেন তা দিয়েই সংসার খরচ চালিয়ে ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করছিল এই পরিবারটি। করোনায় ধাক্কায় তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। টিকে থাকতে ঘরে বাড়তি কিছু আয় যোগ করতে গত ছয় মাস ধরে তাদের ছোট দুই মেয়ে রাস্তায় বসে পথচারীদের ওজন মাপে ও মাস্ক বিক্রি করে।

ওজন মেপে ও মাস্ক বিক্রি করে কোনোদিন ১০০ টাকা আবার কোনোদিন ৪০০ টাকা পর্যন্ত আয় করে লামিয়া-লাবনী। এই টাকা ব্যয় হয় লামিয়ার লিভার ইনফেকশনের চিকিৎসায় আর তার পরিবারে আর্থিক সহায়তায়।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

5h ago