কারা প্রথমে টিকা পাবেন তালিকা হয়নি এখনো
রাজশাহী বিভাগজুড়ে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে টিকাদান কেন্দ্র এবং সংরক্ষণাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কারা টিকা পাবেন সেই তালিকা এখনো তৈরি হয়নি।
কর্মকর্তারা বলছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা কেবল স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্য প্রথম সারির কর্মীদের তালিকাভুক্ত করার কাজ শুরু করেছেন।
প্রবীণ ব্যক্তি এবং দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসাধীন প্রাপ্তবয়স্করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকলেও তাদের তালিকাভুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা এখনো নেওয়া হয়নি।
রাজশাহীর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিচালক ডা. মো. হাবিবুল আহসান তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আটটি জেলার সিভিল সার্জন, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারা কয়েক দিনের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকা সম্পন্ন করবেন। তারপরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং সাংবাদিকদের তালিকাভুক্ত করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবীণ ব্যক্তি এবং সাধারণ মানুষের জন্য কোনো তালিকা করা হচ্ছে না। কারণ সরকার এই মাসের শেষের দিকে একটি স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন চালু করবে, যেখানে সাধারণ মানুষ কোভিড-১৯ টিকা পেতে নিবন্ধন করতে পারবেন। একবার তাদের জাতীয় পরিচয় এবং মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে স্মার্টফোন অ্যাপে নিবন্ধিত হওয়ার পরে বয়স বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণদের বাছাই করা হবে এবং তাদের একটি এসএমএসের মাধ্যমে টিকাদান কেন্দ্রে ডেকে আনা হবে। যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না, তারা সরকারের ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের সাহায্য নিতে পারবেন।’
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে গুজব থাকলেও এই অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তিদের অনেকেই টিকা নিতে আগ্রহী। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার রাজশাহী শহর এবং পবা উপজেলার দারুসা এলাকায় অন্তত ২০ জন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণের বিষয়ে আগ্রহী।
রাজশাহী শহরের উপশহর এলাকার ব্যবসায়ী জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করোনাভাইরাস একটি অদৃশ্য শত্রু। এর জন্য টিকা নিতেই হবে। স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রথম সারির কর্মীরা অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবেন ঠিক আছে, তাদেরই আগে টিকা পাওয়া দরকার। তবে প্রবীণদেরও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
শহরের ঐতিহ্য চত্বরের এক দোকান মালিক মুক্তার আলী বলেন, ‘টিকা না নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে এই টিকা আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।’
টিকাদান কেন্দ্র
রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলায় কমপক্ষে ৬৬২টি কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এই টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
রাজশাহী, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের তিনটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; রাজশাহী, বগুড়া ও নাটোরের চারটি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল; আট জেলার পুলিশ হাসপাতাল; সাত জেলার সদর হাসপাতাল, ৬৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ৫৬৪টি ইউনিয়নে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
এ ছাড়া, আট জেলায় প্রতিটি সিভিল সার্জনের অফিসগুলোতে অতিরিক্ত একটি করে এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশনে একটি টিকাদান কেন্দ্র থাকবে। টিকা সংরক্ষণে ইপিআই কর্মসূচির সুবিধাগুলো ব্যবহার করা হবে।
ঢাকা থেকে টিকার সরবরাহ পাওয়ার পরে জেলা সদরগুলোতে অবস্থিত ইপিআই কোল্ড রুমে টিকা রাখা হবে। তবে নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোল্ড রুম না থাকায় সেখানে টিকা আইস লাইন্ড রেফ্রিজারেটরে (আইএলআর) সংরক্ষণ করা হবে।
ডা. মো. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, ‘কোল্ড রুমগুলোতে প্রচুর জায়গা রয়েছে। একদিনে এক লাখ ২০ হাজার লোককে ভ্যাকসিন দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে।’
একটি টিকাদান কেন্দ্র
বুধবার পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনকালে দেখা যায়, সেখানকার ইপিআই কেন্দ্রে একটি আইএলআর-এ কোভিড-১৯ লিখে ‘কোভিড-১৯টি টিকাদান কেন্দ্র’ করা হয়েছে। একটি আইএলআর আট হাজারের মতো টিকা ধারণ করতে সক্ষম।
মেডিকেল টেকনিশিয়ান জহরুল ইসলাম জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইপিআই কর্মসূচির দুটি আইএলআর-এর মধ্যে একটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, তারা জেলা কোল্ড রুম থেকে একটি শীতল বাকশে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইএলআর-এ ভ্যাকসিনগুলো দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে সংরক্ষণ করা হবে। এভাবে এক মাস ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা সম্ভব। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ভ্যাকসিন ক্যারিয়ারে বিভিন্ন ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়া হবে। চারটি আইস প্যাকের মাধ্যমে ভ্যাকসিন কারিয়ারে ২৪ ঘণ্টা সংরক্ষণ করা সম্ভব।
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিরীক্ষণ কমিটি
কোভিড-১৯ টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের আগামী ২৭ জানুয়ারি থেকে দুদিনের প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তিনটি দক্ষিণ এশীয় দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একযোগে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করবে।
গুজব ছড়িয়ে পড়া এবং কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তারা বলেন, টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণের দরকার হবে।
পবা উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রাবিয়া বসরি হাম ও রুবেলা টিকাদান অভিযান নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘একটি শিশু এমআর ভ্যাকসিন নেওয়ার ছয় দিন পরে শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করে। তখন কিছু গ্রামবাসী গুজব ছড়িয়েছিলেন যে শিশুটি টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ভুগছে এবং স্থানীয় বাসিন্দারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অবরুদ্ধ করেন। আমি সেখানে ছিলাম। আমরা গ্রামবাসীদের বোঝাতে পেরেছিলাম যে এটি কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নয়। কিন্তু যিনি সঠিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে অসচেতন, তিনি বোঝাতে পারবেন না। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মো. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের বিষয়ে সিভিল সার্জন থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শেষ করা হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তার জন্য টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা পার্টি থাকবে। কোনো বিশৃঙ্খলা যেন তৈরি না হয় সে লক্ষ্যে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
Comments